পিয়ন পদে থেকে ৮ বছরে ২০ কোটি টাকার সম্পদ!

কুমিল্লার চান্দিনা পৌর ভূমি অফিসের পিয়ন শরীফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত আট বছরে অন্তত বিশ কোটি টাকার দৃশ্যমান সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। তিনি পূর্ববর্তী সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দীর্ঘ সময় ধরে ভূমি অফিসের প্রায় সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার, ভূমি) অফিসে অভিযোগের স্তূপ জমা পড়েছে।
পিয়ন শরীফুলের বিরুদ্ধে খাস জায়গার দখল বুঝিয়ে দেওয়া, নামজারি (খারিজ) থেকে উৎকোচ আদায়, জাল নথিপত্র তৈরি, ভুয়া দাখিলা সৃজন এবং বাজারের খাস দখলদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, পেরিফেরি দোকান ভিটির খাজনা আদায়ের নামেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। এই সমস্ত অপকর্ম সম্পাদনের জন্য তিনি একটি বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
জেলার দেবিদ্বার উপজেলার তুলাগাঁও এলাকার বাসিন্দা শরীফুল ইসলাম ২০১৭ সালে চান্দিনা পৌর ভূমি অফিসে পিয়ন হিসেবে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে তিনি চান্দিনার তৎকালীন সংসদ-সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়রসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। এই সখ্যতার সুযোগে তিনি পৌর এলাকার ভূমি সেক্টরকে একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন এবং বিগত বছরগুলোতে মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, তিনি চান্দিনা উপজেলা সদরের খাস জায়গা চিহ্নিত করে ক্ষমতাসীন দল ও ছাত্রলীগের নেতাদের দখল বুঝিয়ে দিতেন। ত্রুটিপূর্ণ নামজারি বা ভূমি সংক্রান্ত মামলা দেখলেই তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের লেলিয়ে দিয়ে সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে তা ভাগাভাগি করতেন। একপর্যায়ে স্থানীয় ভূমি সেক্টরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতে চলে যায়, যার ফলে সে সময়ের এসি ল্যান্ড ও পৌর ভূমি কর্মকর্তারাও তার নির্দেশ মানতে বাধ্য হতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাকুরিতে যোগদানের সময় পারিবারিক দৈন্যদশা থাকা সত্ত্বেও শরীফুল ইসলাম চান্দিনা সদরের প্রাণকেন্দ্রে বিশাল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। পৌরসভার শান্তিবাগ আবাসিক এলাকায় প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের চার শতাংশ জায়গার ওপর তিনি একটি চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। একই আবাসিক এলাকায় দুই কোটি টাকা মূল্যের তিন শতাংশের আরও একটি প্লট রয়েছে। এছাড়া, ওয়াপদা সড়কের পাশে হক এন্টারপ্রাইজের পেছনে দেড় কোটি টাকা মূল্যের একটি প্লট, সরকারি হাসপাতালের পাশে জায়গা এবং পৌরসভার বেলাশ্বর এলাকায় মূল্যবান প্লট কিনেছেন। নিজ গ্রামের বাড়িতেও তিনি দশ বিঘার অধিক কৃষিজমি কিনেছেন বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, চান্দিনা বাজারে সরকারি খাস জায়গায় থাকা প্রায় পঞ্চাশটি দোকান ভিটির লিজ মানি আদায় না করে তিনি নিজে উৎকোচ হিসেবে হাতিয়ে নিয়েছেন। বাজারের খাজনা নবায়নের জন্য প্রতি দোকান থেকে এক লাখ টাকা করে ঘুষ আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাজারের খাস জমিসংলগ্ন দোকান ও জায়গা থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। পুরো পৌরসভার সকল জায়গা-জমির খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষকে জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা যায়। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখকদের মাধ্যমে সব নামজারির চুক্তি করতেন শরীফুল।
চান্দিনা বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন। ব্যবসায়ী আলী আকবর জানান, বাজারের লোটো শোরুমের অভ্যন্তরে থাকা আধা শতক খাসজমির জন্য শরীফুল চল্লিশ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পুরোনো জনতা ব্যাংকের পেছনে পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণেও তিনি ত্রিশ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়েছেন। এছাড়া, আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র মফিজুল ইসলামকে সরকারি হাসপাতালের পেছনে পঞ্চাশ ফুট খাল ভরাট করে অবৈধ দখলে সহায়তা করেন এই পিয়ন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দলিল লেখক জানান, পৌরসভার ত্রুটিপূর্ণ প্রায় সব দলিল সম্পাদনে নামজারি ও খাজনার দাখিলা সম্পন্ন করে দিতেন শরীফুল। সদরের শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ইকরাম হোসেন বলেন, শরীফুলের একটি বিশাল দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে এবং তিনি ভুয়া দাখিলা ও নামজারি সম্পাদন করে থাকেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শরীফুল ইসলাম বলেন, “কাজের ক্ষেত্রে আমার ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। কিছু অনিয়ম তো হইছে। এমন অনেকেই করে। আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে ক্ষতি কইরেন না।” চান্দিনা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফয়সাল আল নুর জানিয়েছেন, পিয়ন শরীফুলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এসেছে এবং তার অস্বাভাবিক সম্পদের বিষয়ে অনেকেই বলাবলি করছেন। তিনি জানান, শরীফুলের সকল অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে দেখা হবে।







