ভোটের ‘ট্রাম্প কার্ড’ আওয়ামী লীগের হাতে?

সেলিম সরকার:
প্রশাসনে অস্থিরতা, স্থবিরতা। গতি নেই ব্যবসা-বাণিজ্যেও। আইএমএফ সবশেষ জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না এলে মিলবেনা অর্থ সহায়তা। আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া মাঠ প্রশাসনও আছে অনেকটা আগের মতোই। সচিবালয়ে হালকা রদবদল হলেও জনপ্রত্যাশার ছাপ নেই বাস্তবে। সহজ কথায় আওয়ামীসমর্থক কর্মকর্তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ, সংখ্যায় তারাই বেশি। ফলে, পদে, পদে ফেইল করছে ড. ইউনূস এর অন্তর্বতীকালীন সরকার।
এই অস্থিরতা আর স্থবিরতার মাঝেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ভোটের মাঠে সরব উপস্থিতির জানান দিচ্ছে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। কেবল মাঠে নেই দেশের অপর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।
সরকার দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে। নির্বাচন কমিশনও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করেছে। বিচারের মুখোমুখি দলটির শীর্ষ নেতারা। এমন টালমাটাল অবস্থা সত্ত্বেও আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগই বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তাড়িয়ে বেড়ালেও, এখন সুর পাল্টেছেন এসব দলের স্থানীয় নেতারা। ভোটের হিসাব-নিকাষ কষতে গিয়ে, এখন দলগুলো আওয়ামী ভোটারদের কাছে টানতে শুরু করেছে। আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে খ্যাত হিন্দু ভোটারদের কাছে পেতেও মরিয়া দলগুলো।
ধর্মভিত্তিক দল হওয়া সত্ত্বেও জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ গত দুর্গাপূজায় ছুটে গেছে পূজামণ্ডপে। মুখে সম্প্রীতির বাণী শোনালেও, মূল উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে হিন্দুদের ভোট টানা। সবমিলিয়ে দলগুলো আওয়ামী ভোট ভ্যাংকের দিকেই চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। জাতীয় পার্টিতো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেই দিয়েছে, আওয়ামীলীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের তারা দলের পক্ষে মনোনয়ন দিতে চান।
দিনে জনসভায়, পথসভায় আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচার, ভারতের দোসর বলে গালি দিলেও, রাতের অন্ধকারে কম-বেশি সবদলই আওয়ামী ভোটারদের টানার চেষ্টায় সদা তৎপর। আওয়ামীলীগ নেতাদের মামলা তুলে নেয়া, জামিনে সহায়তা প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সুযোগসহ নানান প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন দলগুলোর স্থানীয় নেতারা।
ভোটের মাঠে জামায়াত যতটা এগিয়ে, অনলাইন প্রচারণায় দলটি তারচেয়ে হাজারগুণ এগিয়ে আছে। অপরদিকে বিএনপির ভোট ব্যাংক যতটা সুবিস্তৃত, অনলাইন প্রচারণায় তারা জামায়াতের চেয়ে বহুধাপ পিছিয়ে।
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল ভোটের পরে মিত্র দলগুলোর বিজয়ী এমপিদের নিয়ে একটা জোট সরকার গঠন করার। কিন্তু জামায়াতের প্রচারণার কৌশলে, কোণঠাসা বিএনপি এখন নির্বাচনের আগেই জোট গঠনে তৎপর। জামায়াতকে ঠেকাতে দলটি ছোট-বড় প্রায় সব দলকেই কাছে টানার চেষ্টা করছে।
জামায়াত বিএনপির সবচেয়ে বড় মিত্র দল হলেও ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর, একেবারে বিপরীত মেরুতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দলটি। দলটি বিএনপিকে চাঁদাবাজ, খুনী এমনকি ফ্যাসিস্ট বলতেও দ্বিধা করছে না। সোস্যাল মিডিয়ায় বিএনপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু বাস্তবে বিএনপির অপরাধের মাত্রা সেই তুলনায় নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তা কাউন্টার করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে দলটি।
কৌশলগত এই প্রচারণাকে কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে দেশের ৪টি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয়ী হয়েছে দলটির ছাত্র সংগঠন শিবির। এখন তাদের দ্বিতীয় মিশন জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া। এজন্য দলটির অনেক নেতাই আওয়ামী ভোটারদের কাছে টানতে ”নিরাপরাধ আওয়ামী লীগ” নেতাকর্মীদের পাশে রাখতে চান।
দলটির শীর্ষ নেতা ডা. শফিকুর রহমান আরেকধাপ এগিয়ে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ভারত সে ডাকে সাড়া দিলে, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক জামায়াতের ঝুড়িতেও পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
অপরদিকে, ভারত বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মনোভাব বুঝতে বিবিসি বাংলার মাধ্যমে ভারতের প্রতি বিএনপির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছে। শাঁখের করাতের মতো সেই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য হয়তো ছিলনা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন, ভারতের সাথে আপাতত সম্পর্ক শীতল থাকবে।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে উষ্ণ সম্পর্কের আশা করাটাও কঠিন। কেননা, দলটি ভারতের বিরোধীতার কারণেই দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা-শাস্তির পেছনেও ভারতের ইন্ধন ছিল বলেই মনে করনে দলটির অনেকে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের পরামর্শে আওয়ামীলীগের সাথে জামায়াতের তলে, তলে সম্পর্ক গড়ে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। দলটি ইতোমধ্যে দলীয় লোগো থেকে ‘আকিম-উদ-দ্বীন’ কথাটি সরিয়ে ফেলেছে। এর মাধ্যমে ভারতসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে তারা নিজেদের কিছুটা সেক্যুলার ধারায় ফেরানো ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা, সেটা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
তবে বিএনপিতে ভারতপন্থী কিছু নেতাও সক্রিয় রয়েছেন। ক্ষমতায় গেলে তারা ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক উষ্ণ করার নিশ্চয়তা দিলে, ভারত সেটাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে পারে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর মনোভাবও ভারতের সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রাজনীতির মাঠের এই ধোঁয়াশার মধ্যেই বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার নানা কৌশল ঠিক করতে নির্ঘুম সময় পাড়ি দিচ্ছে। তবে, হিসাবের সে খাতায় ঘুরে ফিরে নাম আসছে আওয়ামী লীগের, নাম আসছে ভারতের অবস্থানের বিষয়টি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও, তাদের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থক আগামী নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ভুমিকা রাখবে, সেটা অনেকটাই নিশ্চিত।