আমার আর আমার মায়ের মাঝে প্রতিনিয়ত চলে অদলবদলের খেলাঃ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

খ,ম,জায়েদ হোসেন,
(ব্রাহ্মণবাড়ীয়া)প্রতিনিধি।
মা আমার গোটা পৃথিবীর স্বর্গ তুল্য। আম্মা, মা, মাগো, ছোট্ট মা, বাবু, বাবা, ছোট পাখি, কলিজা, কত কত নামে যে, আমি ডাকি আমার মাকে। কয়েক মাসের শিশুকে যেমন নানান নামে ডাকে তার মা।
বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটে তার, ঠিক যেমন ছোট শিশুরা ঘুমিয়ে থাকে দিনের বেশির ভাগ সময়। তুলতে হলে আগে মাথায় হাত রাখি, রেশম শুভ্র চুলে হাত বুলাই খানিকক্ষণ। একটু পর চোখ মেলে তাকান। তার আগে শীর্ণ কাঁপা হাতে আমার হাত ধরেন। বুঝিবা বোঝার চেষ্টা করেন এটা তার মা নাকি। যখন বোঝেন মা, তখন হাতটা নিয়ে ছোট্ট একটা চুমু খান। তারপর ধীরে চোখ মেলেন। কী সুন্দর চোখ, ক্লান্ত কিন্তু ভীষণ মায়াময়। এই একটা ক্লান্ত চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি যা এই লোভী, স্বার্থপর, নোংরা পৃথিবীতে আমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস দেয়। যেকোনো অন্যায় আর মিথ্যার বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে একা, একদম একা চলবার শক্তি জোগায়।
শীর্ণকায়, দুর্বল, ক্লান্ত এক দেবশিশু কী করে আমায় এত শক্তি জোগায়? আমি বুঝি না। আমি সত্যিই বুঝি না। রাব্বে কারিম আল্লাহ পাক প্রতিটি মাকে তার প্রতিনিধি করে পাঠান। না হলে এত অমিত শক্তির আধার তারা হন কী করে! আমার আর আমার মায়ের মাঝে প্রতিনিয়ত চলে অদলবদলের খেলা। কখনো আমি তার মা হয়ে উঠি, কখনো সে আমার মা। একেক সময় মনে হয়, সারা পৃথিবীর সব বিপদ, সব ঝঞ্ঝা থেকে যদি দুহাতে আগলে রাখতে পারতাম তাকে! আবার কখনো মনে হয়, যদি সম্ভব হতো তবে বোধকরি বুকের ভেতর ঢুকিয়ে সবকিছু থেকে আড়াল করে ফেলতাম তাকে। তিনি এখন আর ক্ষুধা পেলে তেমন করে বোঝেন না, গরম লাগছে নাকি ঠাণ্ডা তাও বলতে পারেন না। ঘড়ির সময় ধরে খাওয়াই তাকে, নিজের শরীর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কেমন লাগছে তার, শীত নাকি গরম। গভীর রাতে উঠে দেখি, সব ঠিক আছে তো?
আর যখন ক্লান্ত হই, নিষ্ঠুর নোংরা আর স্বার্থের নিচু হিসাব নিকাশে চলা পৃথিবীর উপর্যুপরি আঘাতে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠি তখন গিয়ে দাঁড়াই মায়ের দরজায়। আমার একমাত্র আশ্রয়। এই আশ্রয়ে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই, আছে শুধু অপার ক্ষমা আর ভীষণ গভীর এক ভালোবাসা। মানুষ নাকি দুনিয়াতে স্বর্গ দেখে না। আমি কিন্তু দেখি। মায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার কপালে চুমু খেতে খেতে আমি স্বর্গ দেখি। তিনি যখন আলতো করে ছোট্ট পাখির ছানাটার মতো বসে খান, তখন তার দুটো চোখে চুমু দিতে দিতে আমি স্বর্গ দেখি। তিনি যখন আমার কোনো কথায় হেসে ওঠেন, আমি স্বর্গ দেখি। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় তার কাছে ‘গুড নাইট’ বলে যখন বাতি নেভাই, আমি স্বর্গ দেখি। আবার তার শরীর বা মন যখন একটু খারাপ হয়, পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে আমার। আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, কাজকর্মের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি প্রতি মুহূর্তে টের পাই এই তীব্র কষ্টের জন্ম এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোনো ভুবনে। এই যন্ত্রণার তুল্য হয়তো শুধু নরক যন্ত্রণাই হতে পারে।
আমাদের দুজনকে খুব কাছে থেকে দেখা এক পারিবারিক বন্ধু আমাকে বলেছিল, মায়ের সঙ্গে আমার নাড়ি নাকি এখনো কাটা হয়নি। আমি সত্যি বলছি, এই নাড়ি কাটা হোক, তা কখনো চাইনি আমি। ধুলো-ময়লার এই পৃথিবীতে একখণ্ড স্বর্গের হাতছানি, কে না চায় বলুন?