মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে জিম্মি ডিমের বাজার

কষ্ট ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ডিম উৎপাদন করেও এর চূড়ান্ত বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে খামারিদের কার্যত কোনো ভূমিকাই নেই। তারা নিজের উৎপাদিত ডিমের দর বিক্রির সময় জানতে পারেন না; এই মূল্য জানতে তাদের ডিম সরবরাহের পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটির মূল নিয়ন্ত্রক হলো মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী, যারা বাজারে ‘মিডিয়া’ নামে পরিচিত।
রাজধানীর তেজগাঁও এবং কাপ্তানবাজারের ডিমের আড়তে আড়তদার, পরিবেশক এবং বড় ক্রেতারা মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে প্রতিদিনের দাম নির্ধারণ করেন। এই নির্ধারিত মূল্য মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে খামারিদের জানিয়ে দেওয়া হয়। সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে ডিমকে পাঁচ থেকে সাতটি ‘মিডিয়া’ বা মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে আসতে হয়। এই বহুধাপের হাতবদলের কারণেই খুচরা বাজারে ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এই ‘মিডিয়া’র জন্ম হয়েছে। খামার থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অতিরিক্ত মার্জিন যুক্ত হওয়ায় বাজার ক্রমাগত অস্থিতিশীল থাকছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের খামারিরা এই সিন্ডিকেটের কাছে সম্পূর্ণরূপে জিম্মি বলে অভিযোগ করেছেন। অসহায় খামারিরা বলেন, যদি দেশের প্রতিটি জেলায় এবং রাজধানীতে কয়েকটি পাইকারি বাজার থাকত, তবে তারা সেখানে সরাসরি ডিম বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পেতেন এবং ভোক্তারাও সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম কেনার সুযোগ পেতেন।
সম্প্রতি বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার মন্তব্য করেন, অনিয়ম এবং অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্বত্বভোগীর হাতবদলের কারণেই অনেক সময় ডিমের দাম বৃদ্ধি পায়। তিনি বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার করার এবং মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত অনিয়ম ও অসাধু কাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক খামারি অভিযোগ করেছেন, ‘মিডিয়া’ চক্র অনেক সময় চাহিদা কম দেখিয়ে খামারিদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত করে। এমনকি তারা তিন-চার দিন ডিম আটকে রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, অথচ এই মূল্যবৃদ্ধির দায় খামারিদের ওপরই বর্তায়।
বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ফার্মের বাদামি রঙের প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবিও তাদের প্রতিবেদনে একই মূল্য উল্লেখ করেছে। অথচ শুক্রবার খামারি পর্যায়ে বাদামি রঙের একটি ডিম সর্বোচ্চ ১০ টাকা ১০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে, যা প্রতি হালিতে দাঁড়ায় ৪০ টাকা ৪০ পয়সা। এই হিসাব অনুযায়ী, খামার থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি ডিমে প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাত্র তিন দশক আগে দেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫টি থাকলেও বর্তমানে তা ১৩৭টিতে উন্নীত হয়েছে। ‘গরিবের প্রোটিন’ হিসেবে পরিচিত ডিমের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ডিম সংগ্রহ প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্থানীয় সংগ্রাহকরা খামারিদের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করে প্রথমে উপজেলার পাইকারদের কাছে দেন। এরপর তা জেলা আড়ত হয়ে ঢাকার পাইকারি বাজারে পৌঁছায়। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতাদের হাত ধরে শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাছে যায়। প্রতিটি স্তরে পরিবহন, গুদাম ভাড়া ও কমিশনের নামে নতুন মূল্য যুক্ত হতে থাকে। গাজীপুরের আজিরন পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. তফাজ্জ্বল হোসেন এবং কিশোরগঞ্জের রহমান পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুর রহমান উভয়েই এই মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থার শিকার।
খামারিরা জানান, সরাসরি ঢাকায় ডিম বিক্রির জন্য ১৪-১৫টি স্থানে পাইকারি বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেও কোনো ফল মেলেনি। তারা আরও বলেন, দেশে ডিম সংরক্ষণের জন্য কোনো বৈধ কোল্ড স্টোরেজ লাইসেন্স না থাকায় উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে গেলে খামারিরা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই সংরক্ষণের সুযোগ না থাকাই ডিমের বাজারকে ‘মিডিয়া’র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। এছাড়া, ডিম উৎপাদনের মোট ব্যয়ের বড় অংশ জ্বালানি ও খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল এবং সয়াবিন মিল, ভুট্টা, প্রিমিক্সের মতো কাঁচামাল আমদানিজনিত কারণে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
এদিকে, তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ বলেন, ঢাকার বাইরের মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমেই তাদের ডিম কিনতে হয়, সরাসরি ফার্ম থেকে নয় এবং এই ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো পাকা রসিদও পাওয়া যায় না। তিনি স্বীকার করেন, কয়েক হাত ঘুরে আসার কারণেই ডিমের দাম বাড়ে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং ক্যাব সভাপতি এ এইচ এম শফিকুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ছোট খামারিদের জন্য ঢাকাতে ডিম পাঠানো কঠিন, তাই এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে খামারিদের সমবায় সমিতি গঠন করা জরুরি। তিনি মনে করেন, তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারের সিন্ডিকেট ভাঙা গেলে ডিমের বাজার স্বাভাবিক থাকবে।







