শিবচরে ১২ কোটি টাকার ট্রমা সেন্টার এখন নিজেই ট্রমাটাইজড

মোঃ শাহিন মিয়া,
শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি:
সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার জন্য মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে নির্মাণ করা হয় ট্রমা সেন্টার। ২০২২ সালে উদ্বোধন হলেও এখনো চালু হয়নি। ফলে এক্সপ্রেসওয়ের পাশেই প্রায় ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রটি কয়েকটি সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ করে রাখলেও জনসাধারণের কোনো কাজেই আসছে না। জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা স্বাস্থ্য বিভাগের। বহিরাগত ছেলেরা ট্রমা সেন্টারের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে মাদক সেবন করে। রাতে এদিকটায় ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার মানুষ সময় বাঁচিয়ে তাদের গšত্মব্যে পৌঁছাতে এ এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করছেন। তবে এ এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করতে গিয়ে গাড়ীর দ্রম্নত গতির কারণে অহরহ ঘটছে দূর্ঘটনা। ফলশ্রম্নতিতে মুহূর্তেই নিভে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের অমূল্য প্রাণ। কেউবা আবার পঙ্গুত্ব বরণ করছেন সারা জীবনের জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পঙ্গুত্ব বরণের হাত থেকে রক্ষার জন্যই ২০২২ সালে এক্সপ্রেসওয়ের শিবচর অংশে নির্মাণ করা হয় ট্রমা সেন্টার। যেখানে চিকিৎসকসহ ৩৪ টি পদে লোকবল থাকার কথা। কিন্তু জনবল নিয়োগ না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এখনও সেন্টারটি সচলই করতে পারেনি। এই ট্রমা সেন্টারটি চালু না হওয়ায় তা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। জিনিসপত্র চুরি হচ্ছে। রাতে পুরো ট্রমা সেন্টার অরক্ষিত থাকে। প্রাঙ্গণজুড়ে এখন ঝোপ-জঙ্গল আর আগাছা। সাব-স্টেশনের কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর করে ও পানির কলসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে চোর-চক্র।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানা যায়, ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় নির্মিত ট্রমা সেন্টারটিতে দুজন আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তাসহ ১৪ জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স ও ফার্মাসিস্ট-টেকনিশিয়ানসহ ৩৪টি পদে জনবল থাকার কথা থাকলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
শিবচর হাইওয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে ১৩৫টি দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া অংশে ৭২টি দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬৪ জন; আহত হয়েছে ৭৮ জন, মামলা হয়েছে ৫৭টি এবং জিডি ১৫টি। জাজিরা-ভাঙ্গা অংশে ৬৩টি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন নিহত ও ৯৪ জন আহত হয়েছে; মামলা হয়েছে ৫৭টি এবং জিডি ১৫টি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আহতদের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এক্সপ্রেসওয়ের পাশের বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ট্রমা সেন্টারটি চালু না হওয়ায় ঢাকা বা ফরিদপুর মেডিক্যালে নিতে নিতে মাঝ পথেই অনেকের জীবন তরী সাঙ্গ হয়ে যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা।
স্থানীয়রা জানায়, বহিরাগত ছেলেরা ট্রমা সেন্টারের ভেতরে ঢুকে মাদক সেবন করে। নিরাপত্তা কর্মীসহ মূল ফটকে তালা না থাকায় ভেতরে ঢোকে মাদকসেবীরা। ভবনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ ফ্যান, বাতি বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র, এসি নষ্ট হওয়ার উপক্রমসহ বেশির ভাগই সরঞ্জাম চুরি হয়ে যাচ্ছে। রাতে এদিকটায় ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রতিষ্ঠানটি মানুষের কোনো কল্যাণেই আসছে না।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল আজিজ জানান, ট্রমা সেন্টারটি চালু হলে আমরা সহজেই উন্নত চিকিৎসা নিতে পারতাম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলায় আমরা সেটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। পাশাপাশি অযত্ন-অবহেলায় বিনষ্ট হচ্ছে কোটি-কোটি টাকার সরকারি সম্পদ।
এদিকে এক্সপ্রেসওয়ের পাশেই নির্মাণ করা ট্রমা সেন্টারটিতে চিকিৎসাসেবা চালু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এই রুটে চলাচলরত পরিবহনচালক ও যাত্রীরা।
প্রচেষ্টা পরিবহনের যাত্রী শাজাহান মিয়া বলেন, আমি প্রতিনিয়ত এ মহাসড়ক দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করি। কিন্তু দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়ার স্থান নেই। তাই দ্রম্নত ট্রমা সেন্টার চালু হলে প্রাণহানি অনেক কম হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এটি জনস্বার্থে দ্রুত চালু করা।
অভিজ্ঞমহল মনে করেন, সড়ক পথে যেকোন দূর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, সাধারণত আহত হয় তার চেয়ে অনেক বেশী। দূর্ঘটনার পর ম্যানেজমেন্ট করতে দেরী হয়ে যাবার কারণে রক্ত ক্ষরণেই হয়তো মারা যাচ্ছে মানুষ, অথবা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অঙ্গের সংযোজন আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা। এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য ট্রমা সেন্টারটি অনতিবিলম্বে সচল করার জন্য তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন।
শিবচর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রম্নত চিকিৎসার জন্য ট্রমা সেন্টারটি থাকলেও পাচ্ছে না। জনসাধারণের সেবার স্বার্থেই ট্রমা সেন্টারটির চালু হওয়া জরুরী।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শরীফুল আবেদীন কমল মুঠোফোনে বলেন, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় ট্রমা সেন্টারটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এটি চালুর জন্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট শাখায় চিঠি দেওয়া হয়েছে । তা অনুমোদনসহ জনবল পদায়ন করা হলে ট্রমা সেন্টারটি সচল করতে আর কোন বাঁধা থাকবে না।






