‘বালুর ট্রাক’ বনাম ‘মগবাজারের তালা’

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়—রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে “তালা” নতুন কিছু নয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় “বাস্টিল দুর্গের তালা” ছিল রাজতন্ত্রের নিপীড়নের প্রতীক। আর সেই তালা ভাঙার মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার নতুন ধারা। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় তালা খোলে না কেউ—কারণ সবাই এখন ‘ফেসবুক বিপ্লবী’।
সেলিম সরকার:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ঠাট্টা-বিদ্রূপের খোরাক” কখনও শেষ হয় না—কখনও বালুর ট্রাক, কখনও তালাবদ্ধ রাজনীতি! এবার সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন “রাজনৈতিক মিম যুদ্ধ” ঘুরছে দুই পুরনো মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে।
ঘটনার শুরু বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে রাখা একসময়কার বালুর ট্রাক থেকে। যে “বালুর ট্রাক” হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় প্রতীকীর মতো। গণতন্ত্রকে বাধা দিতে স্বৈরাচারের সিম্বল হিসেবে। যেটি সরাতে না পারার ঘটনাই তখনকার সরকারের কঠোরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। আজও সেই “বালুর ট্রাক” ইতিহাসের হাস্যরস ও হাহাকারের এক মিশ্র স্মৃতি।
আর এখন- ২০২৫ সালের সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর মগবাজার অফিসের দরজার সামনে ঝুলে থাকা “একটা ছোট তালা” নিয়েই চলছে তুমুল ঠাট্টা-তর্ক! বিএনপি সমর্থকরা বলছেন, “যারা নিজেদের ইসলামী বিপ্লবের সৈনিক বলে দাবি করে, তারা সামান্য একটা তালা খুলতে পারেনি।”
অপরদিকে, জামায়াতপন্থীরা তীর ছুড়ছেন এভাবে- “যারা নিজেদের নেতা-নেত্রীর জন্য রাস্তায় নামে না, তাদের মুখে সাহসের গল্প শুনে হাসি পায়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি আপাত তুচ্ছ হলেও এর ভেতরে আছে এক অদ্ভুত প্রতীকী যুদ্ধ—ক্ষমতাহীনতার লড়াই। এক সময় যারা একে অপরের কাঁধে ভর দিয়ে রাজনীতির মঞ্চ দাপিয়েছিল, এখন তারা সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালে দাঁড়িয়ে একে অপরের ‘লজ্জা’ নিয়ে পোস্ট দিচ্ছে।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী মজার উপমা টানেন এভাবে-
“বালুর ট্রাকটা যদি ক্ষমতার প্রতিরোধের প্রতীক হয়, তবে মগবাজারের তালাটা হলো পরাজয়ের প্রতীক। একটা ভারী, আরেকটা হালকা—তবু দুটোই অচলতার প্রতীক।”
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়—রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে “তালা” নতুন কিছু নয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় “বাস্টিল দুর্গের তালা” ছিল রাজতন্ত্রের নিপীড়নের প্রতীক। আর সেই তালা ভাঙার মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার নতুন ধারা। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় তালা খোলে না কেউ—কারণ সবাই এখন ‘ফেসবুক বিপ্লবী’।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাগুলোর গভীরে রয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের ছায়া—বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির চিন্তাগত অচলাবস্থা। একদিকে সংগঠনের ভেতরকার দুর্বলতা, অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা—দু’য়ে মিলে তৈরি করেছে রাজনৈতিক স্থবিরতার এই কৌতুকময় বাস্তবতা। বালুর ট্রাক বা তালা—দুটোই ছিল একদিকে রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি, আর অন্যদিকে স্বৈরাচারেরও প্রতিচ্ছবি।
কেউ কেউ বলছেন—এই যুগের রাজনীতিবিদেরা এখন আর আন্দোলন করে না, তারা কেবল “আন্দোলনের গল্প” বলে। কেউ বলে “আমরা পারিনি কারণ সরকার কঠোর”, কেউ বলে “আমরা পারিনি কারণ জনগণ চুপ”—কিন্তু কেউ বলে না, “আমরা পারিনি কারণ আমরা বদলাইনি।”
শেষমেশ দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির এই নাট্যমঞ্চে বালু-তালা, ট্রাক-দরজা—সবই প্রতীকে পরিণত হচ্ছে। কেউ ক্ষমতার স্মৃতি আঁকড়ে ধরছে, কেউ প্রতিপক্ষের পরাজয়ের অজুহাত খুঁজছে।
আর জনগণ? তারা ফেসবুক স্ক্রল থামিয়ে মুচকি হাসছে—ভাবছে, যদি কখনো দেশের রাজনীতি সত্যিই এগোয়, তবে এই ‘বালু’ আর ‘তালা’ হয়তো একদিন যাদুঘরে জায়গা পাবে—অচল রাজনীতির স্মারক হিসেবে।








