ভোগান্তির শিকার অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা।

একরামুল ইসলাম তুষার
সহকারী অধ্যাপক, ও কলামিস্ট।
শিক্ষক হলো একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। আজ তারা সমাজে অবহেলিত নেই তাদের যোগ্য সম্মান। কিন্তু আজ তারা ভোগান্তির শিকার। পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য পাওনা। আর্থিক সংকটে চলছে তাদের দিনকাল।
৮৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ সুবিধা পাওয়ার সংকট কাটেনি অবসরপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকের কর্মচারীদের বছরের পর বছর ঘুরে মিলছে ভাতা।
প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষকের আবেদন এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন বছরের পর বছর ধরে।তবে সম্প্রতি সরকার দিয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার তহবিল। কিন্তু এই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরকালীন প্রাপ্য ভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অবসরের ছয় মাসের মধ্যে সব শিক্ষকের পেনশন সুবিধা পরিশোধ করতে হবে।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানা যায়, বর্তমানে অবসর সুবিধা ২০২১ সাল পর্যন্ত আবেদন খারিজ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ২০২২ সালের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করছে। এতে করে আবেদন নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে আবেদনকারীদের দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে একটি আবেদন নিষ্পন্ন হতে গড়ে আড়াই বছর সময় লেগে যাচ্ছে। গত ২ সেপ্টেম্বর ১৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন আদালত। তারও আগে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত ৫ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীকে অবসরের ছয় মাসের মধ্যে অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
ঐ রায়ে আদালত বলেন, শিক্ষকদের অবসরকালীন সুবিধা পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এই হয়রানি থেকে তারা কোনোভাবেই পার পারছেন না। একজন শিক্ষক কত টাকা বেতন পান, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। এ জন্য তাদের অবসরভাতা ছয় মাসের মধ্যে দিতে হবে। এই অবসরভাতা পাওয়ার জন্য শিক্ষকরা বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এখনই পেনশন প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই। অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের পেন্ডিং আবেদনগুলোর অর্থ ছাড় করতে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা দরকার। তবে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের অনুকূলে ২ হাজার কোটি টাকা (বন্ড হিসেবে) এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে ‘মূলধন তহবিল’ গঠনের লক্ষ্যে ২০০ কোটি টাকা (অনুদান হিসেবে) বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
চিকিৎসা, দৈনন্দিন ব্যয় ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন অনেক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক : এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ১৯৯০ সাল থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে অবসর সুবিধা দেওয়া। নীলক্ষেতে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ভবনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়।
অবসরপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষক-কর্মচারী জানিয়েছেন, মাসের পর মাস, কেউ কেউ বছরের পর বছর পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে চিকিৎসা দৈনন্দিন ব্যয় ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনে চরম সংকটে পড়েছেন তারা। এ সব শিক্ষক-কর্মচারী কবে তাদের অবসরভাতা পাবেন তার নিশ্চয়তা নেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকজীবনের শেষ সম্বল অবসরের টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাবেন—তাও সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষকতা শেষ করে বছরের পর বছর অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বারবার রাজধানীর ব্যানবেইস ভবনে এসেও কোনো সুরাহা না হওয়ায় হতাশ মানুষ গড়ার এসব কারিগর। কেউ কেউ প্রয়োজনে ধারদেনা করে জীবন চালাচ্ছেন। অনেক শিক্ষক টাকার আশায় ঘুরে ঘুরে মারা গেছেন। এখন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের পরর্বতী প্রজন্ম । ব্যানবেইস ভবনে ৭০-৮০ বছর বয়সি একাধিক ব্যক্তির কাগজ হাতে কর্মকর্তার জন্য অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারছে না,অনেকের কাছ থেকে জানা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় গেলেও তারা কর্মকর্তার দেখা পাচ্ছেন না।
একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেন, নিজের পাওনাটুকু পাচ্ছি না। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে রোগ-শোক আর অর্থগ্লানি নিয়ে সময় পার করছেন তিনি।
বৃদ্ধ বয়সে এখন দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে : পেনশনের অপেক্ষায় থাকা অবসরপ্রাপ্ত ৬জন শিক্ষক ও কর্মচারী বলেন, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় পার করেছি। বৃদ্ধ বয়সে এখন ভোগান্তিতে রয়েছে দেশের প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষক কর্মচারি। অবসরের শিক্ষকরা জানান, অবসরের পর পরই অবসর সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছেন না তারা। অবসর সুবিধা পেতে ৪-৫ বছর সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষক কর্মচারিদের হাহাকার দিন দিন বেড়েই চলেছে। উল্লেখ্য ২০০২ সালে অবসর সুবিধা বোর্ড চালু হয়। অবসরের ঘাটতি মেটানোর জন্য মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২০২১ সাল থেকে ১০০ টাকা ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়।
চাকরি জীবনে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে যে টাকা কাটা হয় : অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকার বড় একটি অংশ নেওয়া হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকেই। অবসর সুবিধার জন্য চাকরিকালীন তাদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ টাকা মাসে কেটে রাখা হয়। কল্যাণ সুবিধার জন্য কাটা হয় মূল বেতনের ৪ শতাংশ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসরের জন্য ও ৩০ টাকা কল্যাণের জন্য) নেওয়া হচ্ছে। বাকি টাকা সরকারি তহবিল ও চাঁদা জমার সুদ থেকে সমন্বয় করে দেওয়া হয়। নিজেদের জমানো টাকা পেতে বছরের পর বছর ঘুরছেন ৮৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।
অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষকও কর্মচারির সাথে কথা বললে,’ বাংলা ২৪ ঘন্টা” কে বলেনতারা হলেন, উত্তম কর, সহকারী শিক্ষক ২০২৩ সালে ।মো.মুজিবুর রহমান সহকারী শিক্ষক ২০২৪ সালের প্রথম দিকে, ।সুনীল ভট্টাচার্য কর্মচারী, ২০২২ সালে, আনসার আলী, কর্মচারী ২০২৫ সালে কর্মচারী এরা সবাই , চাপরাইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের থেকে অবসরে, মো.মহি উদ্দীন, ২০২২সালে রায়গ্রাম বাণী কান্তমাধ্যমি বিদ্যালয়।
বৃদ্ধ বয়সে এখন দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে : পেনশনের অপেক্ষায় থাকা অবসরপ্রাপ্ত ১০ জন শিক্ষক বলেন, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় পার করেছি। বৃদ্ধ বয়সে এখন দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। চাকরি ছাড়ার পর তাদের আয়-উপার্জন পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের পাওনা টাকা না পাওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে অনেকের শেষ জীবন। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সে তাদের চিকিৎসা দরকার। কারও বা সন্তানের লেখাপড়া কিংবা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া দরকার। কেউ ইচ্ছে পোষণ করেন হজ বা ওমরাহ পালন করার। কিন্তু টাকার অভাবে সবই আটকে আছে। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে তাদের। পরিবারের দিন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে। জানা গেছে, পেনশনের টাকা পেতে দীর্ঘসূত্রতা হওয়ায় এত দিন অসুস্থ ব্যক্তি, হজযাত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি এ ব্যাপারটিও অনুপস্থিত।
আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন না হলে শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও সমাজে মর্যাদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাজেট-সংকটকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অধিকার বঞ্চিত করা চলতে পারে না। শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করায় আজ এই সংকট তৈরি হয়েছে। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন না হলে শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও সমাজে মর্যাদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের তরুণরা শিক্ষা পেশায় আগ্রহ হারাতে পারেন।
দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন এককালীন বিশেষ থোক বরাদ্দ : কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ দিনের জমা পড়া আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় বর্তমানে বোর্ডে বড় অঙ্কের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আগে বিভিন্ন অনিয়মও হয়েছে। এ কারণে অবসর গ্রহণের পরপরই অবসর কল্যাণ সুবিধার টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকদের কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সরকার বন্ড হিসেবে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও এ থেকে শিগিগর তেমন সুফল মিলবে না। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন এককালীন বিশেষ থোক বরাদ্দ। জানা গেছে, কল্যাণ সুবিধা বোর্ডের সব টাকা ও লেনদেন হতো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়েছে। এতে কল্যাণ বোর্ডের ৩০ কোটি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে ব্যাংকটি।
অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত অবসর সুবিধা বোর্ডের ৪৫ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে, যার জন্য প্রয়োজন ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ বোর্ডের মাসিক চাহিদা ৬৫ কোটি টাকা হলেও, তহবিলে জমা হয় মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। ফলে প্রতি মাসে গড়ে ১০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হয়, যা বার্ষিক হিসাবে দাঁড়ায় ১২০ কোটি টাকায়।
এদিকে, শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, কল্যাণ সুবিধার ৪২ হাজার ৬০০টি আবেদন এখনো নিষ্পন্ন হয়নি। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন হবে ৩ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা।