ফ্যাসিস্ট-ঘাতকদের রাইফেলের নলের সামনে সিনা টান করে প্রতিবাদ জানানো এবং একের পর এক গুলি খেয়েও পালিয়ে না গিয়ে প্রতিবাদের ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রংপুরের আবু সাঈদ এই মহাকাব্যিক বিপ্লবের বীরশ্রেষ্ঠ, তাতে কারো কোন দ্বীমত নেই।
আবু সাঈদের বীরত্বের সেই ভিডিও ফুটেজ সারা পৃথিবীর মানুষকে একটা মস্তবড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল, সেটাও সবাই বিশ্বাস করেন। সেই ভিডিও দেখার পর অনেক মা তার সন্তানকে রাজপথে নেমে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন,অনেক বাবা তার সন্তানের হাত ধরে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন ; এমন ঘটনাও বিরল নয়।
অনবরত বুলেটবৃষ্টি উপেক্ষা করে আন্দোলনের সতীর্থদের পানি বিলিয়ে যাওয়া সেই মুগ্ধ ; নিঃসন্দেহে আরেক মহাকাব্যিক বীরশ্রেষ্ঠ, তাতেও কারো অমত নেই।
মুগ্ধের সেই ভিডিও ফুটেজও পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষকে কাঁদিয়েছে।এই ভিডিও দেখে কতো মা যে তার সন্তানকে সাথে নিয়ে বুলেটের বিরুদ্ধে খালি হাতে রুখে দাঁড়িয়েছেন ; কতো বাবা যে তার সন্তানকে নিয়ে মিছিলে ছুটেছেন , কতো বোন যে তার ভাইয়ের হাত ধরে বুলেটের সামনে বুক পেতেছেন, তারও কোন ইয়ত্তা নেই।
শুধু আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধের ভিডিও ফুটেজই নয়।
সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এরকম শত শত ভিডিও
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
এই ভিডিও ফুটেজগুলোই ছিল বিপ্লবীদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। একেকটা বুলেটের বিরুদ্ধে এরকম একেকটা ভিডিও যেনো মিসাইল হয়ে বিস্ফোরিত হচ্ছিল এবং ফ্যাসিস্টদের সকল মারনাস্ত্রকে বিকল করে দিচ্ছিল। বাস্তিল দূর্গের মতো ভেঙ্গে পড়ছিল শতাব্দীর অভিশপ্ত ফ্যাসিস্টদের সকল দম্ভ।
এই ভিডিও ফুটেজগুলোই যেনো বিপ্লবীদের জন্য সের্গেই আইজেনস্টাইনের (সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন ) ‘ব্যাটেলশীপ পটেমকীন’( সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি ) কিংবা মেল গিবসনের ‘ব্রেভহার্ট’ ( ১৯৯৫ সালে দুনিয়া তোলপাড় করা অস্কার বিজয়ী সিনেমা )।
আমার আজকের বয়ান ইতিহাসের সেই সব নেপথ্যের মহানায়কদের নিয়ে । যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধের ভিডিওর মতো অসংখ ফুটেজ ধারণ করেছিলেন এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যথাসময়ে সেগুলো সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
যারা নিজের জীবন বাজি রেখে এই দু:সাহসী কাজটা করেছিলেন, তাদেরকে আমরা কেউ কখনো খুঁজিনি। তাদের এই অবদানের কথাও কেউ কখনো বলিনি। এরা কেউই কিন্তু মুল ধারার মিডিয়ার ডাকসাইটে কোন সাংবাদিকও নন।
মুল ধারার মিডিয়ায় চপেটাঘাত মেরে বিপ্লবের এই সব নেপথ্যের নায়কেরা যে কাজটা করেছেন ; তাকে মিডিয়ার ভাষায় বলা হয় ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’। বৈশ্বিক গিণমাধ্যমে এটার পোশাকী নাম ‘সিটিজেন জার্নালিজম ‘।
আগস্ট বিপ্লবের এক নয়া মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ বা ‘সিটিজেন জার্নালিজম’। একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চমকের একটি হচ্ছে এই ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’। আরেকবার স্যালুট জানাই একুশ শতকের সব যুগান্তকারী বিপ্লবের নেপথ্যের মুল কারিগর এই নাগরিক সাংবাদিকদের।
আগস্ট বিপ্লবের সেইসব নেপথ্যের নায়কদের আরেকবার বিপ্লবী স্যালুট জানাচ্ছি। কারণ, তাদের এইসব ভিডিও ফুটেজ আগস্ট বিপ্লবকে চুড়ান্ত রূপ দিতে সবচেয়ে কার্যকর ভুমিকা রেখেছিল বলে আমি মনে করি। এবং তারা যে পরিস্থিতিতে এইসব ভিডিও ধারণ করেছিলেন ; সেই পরিস্থিতিটা একবার চিন্তা করলে বুঝা যায় যে,এইসব ভিডিও ধারণকারীরাও নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও একটা অগ্নিগর্ভের ভেতরে থেকে খুবই ঠান্ডা মাথায় ভিডিও ধারণ করে গেছেন। এটি গভীরভাবে ভাবতে গেলে কেউই স্থির থাকতে পারবেন না।
আন্দোলনের মাঠ থেকে তোলা সেইসব ভিডিও ফুটেজ দেখেই কিন্তু মানুষের ভেতরে বিপ্লবের ঝড় বয়ে গেছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে ফারজানা লিও নামে ঢাকার এক নারী বলছেন, পরিস্থিতি দেখে আমি মনে করেছি যে, রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করাটা এখন আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের ছেলেদের রক্ষা করতে হবে। এটা আমি ভেবেছিলাম ”।
রাস্তায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আন্দোলন করার ভিডিও দেখে তিনিও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ যতই বাড়ছিল, সেটি পুরুষদের মনেও সাহস যোগাচ্ছিল।
তিনি বলেন, বহু নারী রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে আবার অনেকে বাড়িতে থেকেও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। সন্তান যখন তার মায়ের দিক থেকে সাপোর্ট পায় তখন কোন কিছুই তাকে আটকাতে পারে না।
বুলেটের সামনে আবু সাঈদের বুক টান করা ভিডিও দেখে মায়েরা যেভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন বলে আমি মনে করি। এই মায়েরাই আগস্ট বিপ্লবকে সাহস জুগিয়েছিল,প্রেরণা দিয়েছিল।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আরেকজন মা বলছেন, “মায়ের দিক থেকে যখন আপনি সাপোর্ট পাবেন, তখন সন্তান বলেন আর সহকর্মী বলেন, সবারই বুকের সিনা টান হয়ে যায়। মা যদি সাহস দেয় যে তুমি যাও, তুমি না গেলে দেশের কী হবে? তুমি না গেলে এই দেশকে কে রক্ষা করবে?
“মাতৃত্বটা আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। সন্তান যারই হোক না কেন, প্রত্যেকটা মা মনে করে প্রতিটা সন্তানই আমাদের সন্তান,” বলছিলেন রিদিমার মা সায়মা আহমেদ, যিনি পেশায় একজন স্থপতি। “যখন আমরা দেখলাম যে ভয় পেয়ে তো লাভ নেই, আমাদের বাচ্চাদের তো আমরা বাঁচাতে পারছি না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। তারপরেও তাদের টর্চার করা হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে। তখন তো আমাদের আর ভয় পেয়ে কোন লাভ নেই। আমরা ঘরে থেকে কী করবো,”?
মায়েদের মনের এই পরিবর্তনটা এসেছিল লড়াইয়ের মাঠ থেকে তোলা ওইসব ভিডিও ফুটেজ দেখেই।
সম্প্রতি ভ্যানভর্তি আন্দোলনকারীদের লাশের স্তুপে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলার বিভৎস্য ভাইরাল ভিডিওর কথাও যদি বলেন, তাহলেও বলতে বাধ্য হবেন যে এটা একটা ইতিহাসের পালাবদলের সাক্ষী। কিংবা রক্তাক্ত বিপ্লবের আরেকটা ‘ব্যাটেলশীপ পটেমকীন’।
আসুন আমরা আমাদের মহাকাব্যিক বীরশ্রেষ্টদের পাশাপাশি আগস্ট বিপ্লবের সেইসব নেপথ্যের মহানায়কদের অবদানের কথাও স্মরণ করি। তাদের সেই ভিডিও ফুটেজগুলোর অবদানের কথাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করি।
আসুন। খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কোন্ মহানায়কেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এরকম ভিডিও ফুটেজ ধারণ করেছিলেন এবং তা গোটা পৃথিবীর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে একটা নতুন জাতির জন্ম হয়েছিল। যার ফলে আমরা দেখতে পেয়েছি- ‘বার্থ অব এ নেশন’।
লেখক: এফ শাহজাহান, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
স্কুল অব জার্নালিজম, 02 আগস্ট 2024
Leave a Reply