ঋণ-দাদনের জালে বরগুনার আমতলী-তালতলীর জেলেরা

মাছ ধরা যখন বন্ধ থাকে, তখন জেলেদের সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় অন্য আয়-রোজগার তেমন থাকে না। এ কারণে সংসার চালাতে কিংবা পরিবারের সদস্যদের মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে জেলেরা হাত পাতেন বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে। ঋণ নিয়ে তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান করলেও পরবর্তী সময়ে যা আয় করছেন তা দিয়ে চালাচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কিস্তি। ঋণ-দাদনের কিস্তির টাকা দিতে গিয়ে বাড়তি কোনো টাকা আর সঞ্চয় রাখতে পারছেন না। ফলে ঘুরে-ফিরে সেই ঋণ-দাদনের জালেই জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে জেলেদের।
মহিবউল্লাহ কিরন, বরগুনা:
জাল দিয়ে মাছ ধরে যাদের জীবন-জীবীকা চলে, তারাই আটকে গেছেন ঋণের জালে। বরগুনার উপকূলীয় উপজেলা আমতলী ও তালতলীতে নিবন্ধিত ১৪ হাজার ৬৮৯ জন ইলিশ জেলে ঋণ ও দাদনের ভয়াবহ জালে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে আমতলীতে রয়েছেন ৬৭৮৯ জন এবং তালতলীতে ৭৯০০ জন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পেশায় জড়িত এসব জেলেরা ঋণ-দাদনের টাকা শোধ করতে না পেরে দারিদ্র্যের কষাঘাতে আটকে আছেন।
জেলেদের অভিযোগ, ঋণ বা দাদনের টাকায় অনেকটাই বন্দি হয়ে পড়েছেন আমতলী তালতলী উপকূলের জেলেরা। বিষখালী ও পায়রা নদীতে এবার ভরা মৌসুমেও মাছের তীব্র সঙ্কট ছিল। বছরের ৩ বারে প্রায় ৬ মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে। সরকারি সহযোগিতা হিসেবে শুধু কিছু চাল দেয়া হয়, যা চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল। আর এই সঙ্কট মোকাবিলায় জেলেরা দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হন।
দাদন মূলত: কোনো কাজের বিনিময়ে অগ্রিম টাকা দেওয়াকে বুঝায়; যা পরবর্তীতে গ্রহীতা কাজ বা উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থদাতাকে পরিশোধ করেন। মাছ ধরা যখন বন্ধ থাকে, তখন জেলেদের সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় অন্য আয়-রোজগার তেমন থাকে না। এ কারণে সংসার চালাতে কিংবা পরিবারের সদস্যদের মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে জেলেরা হাত পাতেন বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে। ঋণ নিয়ে তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান করলেও পরবর্তী সময়ে যা আয় করছেন তা দিয়ে চালাচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কিস্তি। ঋণ-দাদনের কিস্তির টাকা দিতে গিয়ে বাড়তি কোনো টাকা আর সঞ্চয় রাখতে পারছেন না। ফলে ঘুরে-ফিরে সেই ঋণ-দাদনের জালেই জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে জেলেদের।
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের প্রান্তিক অঞ্চল সিডর আইলার বন্যায় বিধ্বস্ত নদীকেন্দ্রিক জেলা বরগুনার বিষখালী ও পায়রা উপকূলীয় এলাকা ঘুরে জানা যায়, নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোর জেলেরা হতদরিদ্র, মৎস্য শিকারের ওপর তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। জীবিকার প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় তাদের। তবে জেলেদের কষ্টের আয়ের প্রায় সবটাই চলে যায় দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে।
জেলেদের অভিযোগ করেন, দাদন ব্যবসায়ীরা তাঁদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে মাছের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করছেন। মৌসুমে কেজিপ্রতি ইলিশের দাম ৫০ থেকে ১৫০ টাকা কমিয়ে দেন দাদন ব্যবসায়ীরা। প্রতিবাদ করলেই দাদনের টাকা ফেরতের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।তারা বলছেন, একবার দাদনের টাকা নিলে সারাজীবনেও তা আর শোধ সম্ভব হয় না।
তবে দাদন ব্যবসায়ীরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তালতলীর ফকিরহাট মৎস্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক মজিবর ফরাজী বলেন, “লাখ লাখ টাকা খাটিয়ে সারা বছর জেলেদের পাশে থাকি। যখন মাছ ধরে তখন কিছু টাকা কেটে রাখা হয়।”
তালতলীর গাবতলীর জেলে ছাত্তার বলেন, “গত বছর জাল-নৌকা বানাতে দাদন নিতে হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এখন মহাজনের ইচ্ছামতোই ইলিশ বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে আমরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।”
আমতলীর নাইয়াপাড়ার জেলে নাঈম আক্ষেপ করে বলেন, “দশ বছর যাবত দাদন শোধ করতে পারিনি। জানি না কোনোদিন পারব কি না।”
বৃদ্ধ জেলে সৈয়দ আকন বলেন, “সারাজীবন ইলিশ ধরেও দাদন শোধ করতে পারলাম না। সরকার যদি জাল-নৌকা দিত, মহাজনের কাছে যাইতে হইত না।”