তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে উত্তাল উত্তরাঞ্চল, আন্দোলনে লাখো মানুষ

তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রাখা এবং ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। এই ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা তিস্তা অববাহিকাজুড়ে প্রতিবাদ আর ক্ষোভের আগুনে মশাল প্রজ্বলন করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রায় লাখো মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দফার অংশ হিসেবে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও রংপুরের মোট ১১টি স্থানে এই মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি একযোগে পালন করা হয়। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুরো তিস্তা অববাহিকায় এক উত্তাল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
লালমনিরহাট জেলার তিস্তা রেলওয়ে সেতু সংলগ্ন চর পয়েন্টে এই মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তিস্তা নদী রক্ষা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু। এ সময় বিক্ষুব্ধ তিস্তাবাসীর কণ্ঠে নানা স্লোগান শোনা যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’, ‘পানি আগ্রাসন মানি না মানব না’, ‘পানির ন্যায্য হিস্যা চাই-দিতে হবে দিতে হবে’ এবং ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু কর-করতে হবে’। এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া তিস্তাপাড়ের হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সরাসরি ভারতের দিকে আঙুল তুলে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে তিস্তাকে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত করার জন্য তীব্র নিন্দা জানান এবং ভারতকে ‘পানি আগ্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দেন। এর আগে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি এই নদীবেষ্টিত ৫ জেলার মানুষ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে টানা ৪৮ ঘণ্টার প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছিল।
কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুর রহমান, কফিল উদ্দিন, বাচ্চু মিয়া, অলিমা বেগমসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, বর্ষাকালে খরস্রোতা রূপে দেখা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে তিস্তাকে চেনাই যায় না, পানির অভাবে এটি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। তাদের অভিযোগ, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়েছে। জীববৈচিত্র্য প্রায় বিলীন হয়ে গেছে, জেলে আর মাঝিদের কর্মব্যস্ততা নেই বললেই চলে। থমকে যাওয়া উপার্জনের কারণে লাখো পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিস্তাপাড়ের বাসিন্দাদের মূল অভিযোগ হলো, ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলস্বরূপ, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়, অথচ শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পানি মিলছে না।
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন চললেও কোনো সুফল না পাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর ১২৫ কিলোমিটার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ বর্তমানে অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জেলেরা কর্মহীন এবং মাঝিরা নৌকা বাইতে না পারায় বেকার হয়ে পড়েছেন; এখন হেঁটেই তিস্তা পার হওয়া সম্ভব। পানির অভাবে কৃষকরা কৃষি উৎপাদন করতে পারছেন না। নদীপাড়ের প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে দ্রুত তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি বলে তারা মনে করেন। তিস্তা পাড়ের মানুষজন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তিস্তা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। জনগণের দাবি, তিস্তা নিয়ে কোনো রাজনীতি নয়, তারা অতিদ্রুত চীনের অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার দৃশ্যমান কাজ দেখতে চান। তাদের বিশ্বাস, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদীতে বছরজুড়ে পানি থাকবে, কর্মসংস্থান হবে এবং গোটা উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন-চিত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে।