বরগুনার বিষখালী নদী-তীরের মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়: ভাঙনের মুখে বসতবাড়ি

বরগুনার প্রাণপ্রবাহ বিষখালী নদী। একসময় এ নদী ভরসা ছিল নদীপাড়ের মানুষের—মাছ, কৃষি ও নৌ-যান চলাচলে নির্ভরশীল জীবিকা গড়ে উঠেছিল এ নদীকেন্দ্রিক। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ নদীর তীর হয়ে উঠেছে মাটি ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যবস্তু। নদীর পাড় খুঁড়ে প্রতিদিন শত শত ঘনফুট মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, হুমকির মুখে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ।
মহিবউল্লাহ কিরন, বরগুনা:
“মোগো রাস্তার পাশে সব ঘর, গাং পাড়ের মাটি কাটলেই তো মোগো ঘর বাড়ি সব শ্যাষ। এই ঘরটুকু গেলে আমাগো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াইতে হইবে”- নদী ভাঙনে বসতবাড়ি হারানোর শঙ্কা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বরগুনার বিষখালী নদীপাড়ের এক বাসিন্দা। বাস্তুহারা হওয়ার এই আতঙ্ক অবৈধ মাটি খেকোদের কারণে।
বরগুনার বিষখালী নদীর দুই তীরজুড়ে প্রায় তিন যুগ ধরে চলছে অব্যাহত নদী ভাঙন। সেই ভাঙনকবলিত স্থানগুলো থেকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্যে স্ক্যাভেটর (ভেকু) মেশিন দিয়ে মাটি কেটে ট্রলারে করে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে মাটি খেকোর দল। এরা নির্বিঘ্নে নদীর পাড়ের মাটি কেটে নেয়ার ফলে নদী ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠছে। এদিকে নদী তীরের মাটি কেটে নেয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো।
বরগুনার প্রাণপ্রবাহ বিষখালী নদী। একসময় এ নদী ভরসা ছিল নদীপাড়ের মানুষের—মাছ, কৃষি ও নৌ-যান চলাচলে নির্ভরশীল জীবিকা গড়ে উঠেছিল এ নদীকেন্দ্রিক। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ নদীর তীর হয়ে উঠেছে মাটি ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যবস্তু। নদীর পাড় খুঁড়ে প্রতিদিন শত শত ঘনফুট মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, হুমকির মুখে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের বাইনচটকি এলাকায় বিষখালী নদীর তীর কেটে অবৈধভাবে মাটি নিচ্ছেন স্থানীয় কয়েকটি ইটভাটার মালিক। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা ।
জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বরগুনায় প্রায় ৬৮টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের অনুমোদন নেই। অধিকাংশ ভাটা নদীতীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠায় মালিকরা নদীর চর থেকে মাটি কেটে ইট তৈরিতে ব্যবহার করছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে কাকচিড়া ও বাইনচটকি এলাকায় আরএসবি ও আল মামুন এন্টারপ্রাইজের চারটি ইটভাটায় ভেকু মেশিন দিয়ে নদীর তীর কেটে মাটি তোলা হচ্ছে। নদী থেকে বেকু দিয়ে মাটি কাটার একটি ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই নদীর পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আরএসবি ইটভাটার একটি বার্জে বেড়িবাঁধ থেকে মাত্র ২০০–৩০০ ফুট দূরে নদীর তীর কেটে মাটি তোলা হচ্ছিল। গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত হওয়ায় মাটি কাটা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়। এ সময় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের উসকে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ভাটা মালিক কিসলু মিয়ার বিরুদ্ধে।
নদীর তীরে গভীর গর্ত করে মাটি তুলে পাশে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রকল্পের নামে মাছ চাষ দেখিয়ে প্রশাসনকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে ভাটা মালিকরা। এতে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নদীর তীর থেকে কিসলু মিয়া মাটি কেটে নিচ্ছেন। এতে ভাঙন হলে আমরা গরিব মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হারাব।’
অন্য একজন বাসিন্দা জানান, ‘আমাদের এলাকা ভাঙন কবলিত। ভাটা মালিকরা নদীর পাড় কেটে নিলে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হতে সময় লাগবে না।’
অভিযোগের বিষয়ে মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মো. লিটন বলেন, ‘আমরা যে জমি থেকে মাটি নিচ্ছি তা ক্রয়কৃত। এটি সরকারের জমি নয়।’
বরগুনা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আরএসবি ইটভাটার মালিক আবদুর রাজ্জাক কিসলু দাবি করেন, ‘যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে তা রেকর্ডীয় জমি। দলিল ও খতিয়ান দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’
তবে পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, ‘নদীতীর কেটে মাটি নেওয়ায় ভাঙন বাড়ছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। এতে পরিবেশ, মৎস্যসম্পদ ও প্রাকৃতি হুমকির মুখে পড়ছে। প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
নদী গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন নদীর তীর কেটে মাটি নেওয়া হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় । এতে একদিকে নদী ভাঙন তীব্র হয়, অন্যদিকে বাঁধ দুর্বল হয়ে বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকি তৈরি হয়।
“বিষখালী নদী বরগুনা অঞ্চলের প্রাণরেখা। এ নদীর তীর যদি এভাবে কেটে নেওয়া হয়, তাহলে শুধু বাড়িঘর নয়, পুরো বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়বে।”
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন , প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, কিছু প্রভাবশালী মহল প্রশাসনের নীরবতার সুযোগ নিচ্ছে।
এবং প্রশাসনের নীরবতাকে কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অবৈধ ইটভাটা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা দ্রুত ইটভাটা উচ্ছেদ ও নদী দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, নদীর তীর কেটে মাটি নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। তাছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো ইটভাটা চালানোও বেআইনি। কিন্তু স্থানীয় সূত্র বলছে, বরগুনা জেলায় বেশ কিছু ইটভাটা পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এ ব্যবসা বছর বছর বিস্তৃত হচ্ছে।
বরগুনা নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক নির্মল কুমার রায় প্রতিদিনের কাগজকে জানান , ‘নদীর তীর কেটে মাটি নেওয়া হলে তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান জানান , ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। অভিযান চলছে। কেউ নদীর চর থেকে মাটি কাটায় জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষখালী নদীর তীর থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে নেওয়া কেবল একটি পরিবেশগত অপরাধ নয়, বরং মানুষের টিকে থাকার অধিকারকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে । বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে নদীপাড়ের মানুষ দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন । সকলের ধারনা এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই বরগুনার মানুষের সামনে দেখা দেবে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।