দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর অবশেষে ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। এই ঐতিহাসিক সমঝোতার ভিত্তিতে উপত্যকাটিতে সংঘাতের অবসান ঘটবে এবং দুই পক্ষ বন্দিবিনিময় শুরু করবে। সমঝোতা অনুযায়ী, গাজার নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনারাও সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। এই যুদ্ধবিরতিতে দুই পক্ষের রাজি হওয়ার খবর সামনে আসার পর গাজার সাধারণ বাসিন্দারা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন। একইসঙ্গে হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের মুক্তি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় ইসরায়েলের তেলআবিবসহ বিভিন্ন শহরেও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে।
শারম আল শেখে শান্তি আলোচনার ফল
মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে বিগত কয়েক দিন ধরে চলমান পরোক্ষ আলোচনার তৃতীয় দিনে গত বুধবার এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয় হামাস ও ইসরায়েল। গাজায় সংঘাত বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’র ভিত্তিতে এই আলোচনা চলছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর এবং তুরস্কের মতো দেশগুলি।
বুধবার রাতে যুদ্ধবিরতিতে দুই পক্ষের সম্মতি জানানোর খবরটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ লেখেন, “আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে ইসরায়েল ও হামাস—দুই পক্ষই সই করেছে। এর অর্থ হলো খুব শিগগিরই সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। আর ইসরায়েল সমঝোতার ভিত্তিতে একটি এলাকা বরাবর সেনা প্রত্যাহার করবে। এটি শক্তিশালী, টেকসই ও চিরস্থায়ী শান্তির পথে প্রথম ধাপ।” ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরপরই বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির অনুমোদনের কথা। ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র শশা বেডরোসিয়ান জানিয়েছিলেন, মন্ত্রিসভার অনুমোদনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর শুরু হবে।
হামাসও এই চুক্তিতে রাজি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা জানিয়েছে, এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছানো গেছে যা গাজায় দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান ঘটাবে। পাশাপাশি উপত্যকাটি থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, জরুরি ত্রাণ প্রবেশ এবং বন্দিবিনিময়ের পথও সুগম হবে। পরবর্তীতে হামাসের আলোচক দলের প্রধান খলিল আল-হায়া ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশ নিশ্চয়তা দিয়েছে যে গাজার এই ‘যুদ্ধ’ পুরোপুরি শেষ হয়েছে।
চুক্তি ও শর্তাবলী: বন্দিবিনিময়ের সুযোগ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে টানা নৃশংস হামলায় গাজায় দুই ধাপে মাত্র দুই মাসের কিছু বেশি সময় যুদ্ধবিরতি ছিল। বাকি পুরোটা সময়ে হামলায় নিহত হয়েছেন ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এমন প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি নতুন করে জীবন ও স্বস্তির আশা জাগিয়েছে।
শারম আল শেখে যে শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে, তা গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা, উপত্যকাটিতে থাকা জিম্মিদের ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, হামাসকে অস্ত্রমুক্ত করা এবং সংঘাত-পরবর্তী গাজা পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ট্রাম্পের ঘোষণার দিনই ইসরায়েল এই পরিকল্পনায় সম্মতি দেয়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং অস্ত্রসমর্পণের মতো কিছু বিষয়ে হামাসের আপত্তি ছিল, তা সত্ত্বেও তারা যুদ্ধবিরতি, জিম্মি মুক্তি ও সেনা প্রত্যাহার সংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয়ে রাজি হয়।
বুধবার যে চুক্তিটি নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার বিস্তারিত শর্তাবলী এখনও পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। ট্রাম্প সমঝোতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের কথা বললেও সেই এলাকার পরিধি খোলাসা করেননি। তবে হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত একটি মানচিত্রে তিন ধাপে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি মুখপাত্রের বরাতে বিবিসির খবর অনুযায়ী, চুক্তি অনুসারে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান কিছুটা পিছিয়ে আনা হবে, তবে উপত্যকাটির প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলি বাহিনীর হাতেই থাকবে। বর্তমানে গাজার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা সিবিএসকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা চুক্তিতে অনুমোদন দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্দিষ্ট এলাকা বরাবর ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হতে পারে এবং জিম্মিদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত আনা হতে পারে। বর্তমানে গাজায় প্রায় ২০ জন জীবিত জিম্মি আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। চুক্তি অনুসারে, বাকি জিম্মিদের ফেরত পাওয়ার পর ইসরায়েল তাদের কারাগারে বন্দী ১ হাজার ৯৫০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে। যাদের মধ্যে ২৫০ জন মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত।
বিশ্বজুড়ে স্বস্তি, তবুও কাটছে না শঙ্কা
যুদ্ধবিরতির খবরে গাজার ফিলিস্তিনিরা বৃহস্পতিবার রাস্তায় নেমে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তবে গাজাবাসীর মনে শঙ্কাও রয়েছে। তারা ইসরায়েল সরকারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না, কারণ সর্বশেষ গত মার্চ মাসেও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে হামলা শুরু করেছিল। খান ইউনিস এলাকার বাসিন্দা আবুল মাজেদ আবদ রাব্বো আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেও, আবু হাসেমের মতো অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর আবার হামলা শুরু হবে কি না। তাদের এই ভয়ের কারণও রয়েছে, কারণ বৃহস্পতিবারও গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত দশজন নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে, এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা প্রকাশ করেছে যে এই চুক্তির মাধ্যমে গাজায় ‘যুদ্ধ’ পুরোপুরি বন্ধ হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার কথা বলেছেন। এছাড়াও রাশিয়া, ফ্রান্স, ভারত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ দশটি দেশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই চুক্তিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তিনি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজায় ত্রাণ সরবরাহ ও পুনর্গঠনকাজ শুরু করার জন্য জাতিসংঘকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পরে সংঘাত-পরবর্তী গাজা কীভাবে শাসন করা হবে এবং ত্রাণ সরবরাহ কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, তা নির্ধারণের লক্ষ্যে প্যারিসে ইউরোপ ও আরবের বিভিন্ন দেশের নেতা ও প্রতিনিধিদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকে যোগ দেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁসহ যুক্তরাজ্য, জার্মানি, স্পেন, মিসর, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিরা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি চলতি সপ্তাহের শেষে বা আগামী রোববারের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যেতে পারেন এবং রোববার তিনি ইসরায়েলে থাকবেন।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও নজরদারির প্রয়োজনীয়তা
ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও, হামাসের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও অস্ত্রসমর্পণ নিয়ে যে আপত্তি ছিল, তার কোনো সুরাহা এখনও হয়নি। ফলে প্রথম ধাপের পর চুক্তি কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। এছাড়াও নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ‘ইসরায়েলের বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করলেও তাঁর অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচের মতো মন্ত্রিসভার সদস্যরা বলেছেন, জিম্মিরা ইসরায়েলে ফেরার পর তাদের মনোযোগ থাকবে হামাসকে নির্মূল করার দিকে।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অধিকার সংগঠন ডনের ফিলিস্তিন-ইসরায়েলবিষয়ক পরিচালক মাইকেল শেফের ওমের-মানের মতে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তগুলো ইসরায়েল সঠিকভাবে মেনে চলছে কি না, তার ওপর নিবিড় নজরদারি বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল যেন আবার গাজায় নতুন করে হামলা শুরু না করে, অবরোধ আরোপ না করে এবং সীমান্ত দিয়ে ত্রাণ, বাণিজ্যিক পণ্য ও মানুষের চলাচলে কোনো বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।