ইসলামি ব্যবসার মূলনীতি: সততা, নিষ্ঠা ও বরকত

রাশিদুল ইসলাম রাশেদ:
ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বকালে সর্বব্যাপী এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। কুরআন-হাদিসের মধ্যে ব্যবসা ও সৎ ব্যবসায়ী সম্পর্কে অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যেই রয়েছে জাগতিক আর্থিক উন্নতি-অগ্রগতি। উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে রয়েছে বরকত ও সমৃদ্ধি।
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ সা. নিজেই ব্যবসা করেছেন, অন্যদেরকেও ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। হালাল জীবিকা উপার্জন করা ফরজ। জীবিকা উপার্জনের যে সকল বৈধ পন্থা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য অন্যতম।
সহজ অর্থে ক্রয়-বিক্রয় অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে কম মূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে মুনাফা অর্জনের আশায় তা অধিক মূল্যে বিক্রয় করাকে বুঝায়। কিন্তু ফুকাহায়ে কিরামগণ ক্রয়-বিক্রয় এর বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন- (১) একটি মালের বিনিময়ে কাউকে অন্য মালের মালিক বানিয়ে দেয়া, (২) পরস্পরের সম্মতিক্রমে একটি মালকে অন্য মালের সহিত বিনিময় করা, (৩) বিনিময় পেয়ে কোনো জিনিস নিজ মালিকানা হতে বের করে দেয়াকে ক্রয়-বিক্রয় বলে।
সুতরাং ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক বিনিময় যা ইজাব (প্রস্তাব) এবং কবুল (সম্মতি) এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
ব্যবসা শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়। এটি মানুষে মানুষে বিশ্বাস, সহযোগিতা এবং মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর কাছে লাভ-ক্ষতির হিসাব যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা।
আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন,
“সৎকাজ ও তাকওয়ার ব্যাপারে একে অপরকে সহযোগিতা করো, পাপ ও অন্যায়ের কাজে নয়।”
— (সুরা মায়িদা, আয়াত ২)
ব্যবসা যখন সততা, ন্যায় এবং আল্লাহভীতি অনুসারে পরিচালিত হয়, তখন তা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য বরকতপূর্ণ হয়ে ওঠে।
একজন ব্যবসায়ী, যিনি হালাল উপার্জনের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটান, তার ব্যবসায় আল্লাহ বরকত দেন। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, “সৎ নিয়ত এবং আল্লাহর ওপর ভরসা ছাড়া ব্যবসায় সত্যিকারের সফলতা আসে না।”
সততা একজন ব্যবসায়ীর সবচেয়ে বড় সম্পদ। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।” লেনদেনে প্রতারণা, গোপনীয়তা বা মিথ্যা কথা বরকত নষ্ট করে দেয়। সহিহ বুখারিতে আছে, যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে, তাদের লেনদেনে বরকত আসে; মিথ্যা বললে বরকত উঠে যায়।

ইসলামি ব্যবসার মূলনীতি: সততা, নিষ্ঠা ও বরকত
একজন দোকানদার আপেল বিক্রি করছেন। যদি তিনি ক্রেতাকে সঠিক ওজনের আপেল দেন, সঠিক দাম বলেন এবং ক্রেতাকে প্রতারণা না করেন, তার ব্যবসায় বরকত আসে। কিন্তু যদি তিনি কিছুটা কম দেন বা মিথ্যা বলেন, তা শুধু তার সম্মান নষ্ট করে না, বরং ব্যবসায় বরকতও চলে যায়।
ইসলাম ব্যবসায় প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যা কথা এবং সুদ গ্রহণকে নিষিদ্ধ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ সুদগ্রহীতা, প্রদানকারী ও সাক্ষী—সবার ওপর অভিশাপ দিয়েছেন।
”রাসুল (সা.) বলেছেন,
“আল্লাহ সুদগ্রহীতা, প্রদানকারী ও সাক্ষী—সবার ওপর অভিশাপ দিয়েছেন।”
— (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৫৯৮)
ব্যবসার নিয়ম-কানুন মেনে চলা মানে শুধু আইন নয়, বরং আল্লাহর হক আদায়ও।
একজন প্রকৃত মুসলমান ব্যবসায়ী কখনো নামাজের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারে না। জুমার দিনে ব্যবসা বন্ধ করে নামাজে ধাবিত হওয়া তার ঈমানের পরিচায়ক।
আল্লাহ বলেন,
“যখন জুমার আহ্বান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো।”
— (সুরা জুমআ, আয়াত ৯)
ব্যবসার লেনদেনে যেন শয়তানি প্রভাব বা গুনাহ প্রবেশ করতে পারে, তাই তা দান-সদকার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। রাসুল (সা.) বলেছেন, “হে ব্যবসায়ীরা! শয়তান তোমাদের লেনদেনে প্রবেশ করে; তাই দান-খয়রাতের মাধ্যমে তা পরিশুদ্ধ করো।”
দান-খয়রাত কখনো ধন কমায় না; বরং বরকত বৃদ্ধি করে। সুতরাং যে ব্যবসা সততা, ন্যায় ও আল্লাহভীতি ছাড়া করা হয়, তা কখনো বরকত পায় না। সৎ ও নৈতিক ব্যবসা একদিকে ব্যক্তি ও পরিবারকে সমৃদ্ধ করে, অন্যদিকে সমাজে বিশ্বাস, সহযোগিতা এবং মানবিকতার বন্ধন গড়ে তোলে।
ব্যবসা কেবল অর্থের জন্য নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মানুষের কল্যাণের জন্যও করা উচিত। হালাল আয়, সততা এবং ন্যায্য আচরণ ব্যবসায় বরকত আনতে পারে, যা দুনিয়া ও আখিরাত—দু’পক্ষেই সমৃদ্ধি এবং শান্তি নিয়ে আসে।
ইসলাম হারাম পন্থায় অর্থ উর্পাজন যেমন নিষিদ্ধ করেছে, তেমনি অর্থ উপার্জনের হালাল পন্থাও বাতলে দিয়েছে। পৃথিবীতে জীবন যাপনের জন্য প্রতিটি মানুষেরই জীবিকার প্রয়োজন। আর আল্লাহ পাক নিজেই সে জীবিকা পৃথিবীতে তৈরি করে রেখেছেন। সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সে জীবিকা সংগ্রহ করাও ইবাদত হিসেবে গণ্য।
জীবিকা উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা বা পেশার কাজ রয়েছে এসবের মধ্যে ব্যবসা হচ্ছে জীবিকা উপার্জনের সর্বোত্তম পেশা। বিশ্বনবী সা. খোলাফায়ে রাশেদীন এবং অধিকাংশ সাহাবী ব্যবসা করে জীবিকা উপার্জন করতেন। সুতরাং মুসলিম জাতির ঐতিহ্য পেশা হচ্ছে ব্যবসা। জাতি হিসেবে আমাদের সেই ঐতিহ্য ধারণ করতে হবে।
-বাংলার ২৪ ঘন্টা