ভুল স্বীকারের শক্তি : সততার সর্বোচ্চ পরীক্ষা

যে ব্যক্তি নিজের ভুল স্বীকার করে না, সে ক্রমে অহংকারী হয়ে ওঠে। নিজের দুর্বলতা না মেনে নেওয়ার ফলে সে বারবার একই ভুল করে। এতে আত্মবিকাশ থেমে যায়, সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়ে এবং আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। ইতিহাসে ফেরাউন, নামরুদ বা কারুনের মতো ব্যক্তির পতনের মূল কারণও ছিল এই অহংকার।
মানুষ ভুল করবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কিংবা পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ অনেক সময় ভুল পথে চলে যায়। তবে ভুল করা যতটা স্বাভাবিক, সেই ভুলে অটল থাকা ততটাই ক্ষতিকর। নিজের ভুল স্বীকার করা, সংশোধনের চেষ্টা করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা এটাই একজন সৎ ও সচেতন মানুষের লক্ষণ।
সমাজে ভুল স্বীকার করা অনেকের কাছে দুর্বলতার প্রতীক মনে হয়। অথচ বাস্তবে এটি দুর্বলতা নয়, বরং নৈতিক শক্তির প্রকাশ। যে ব্যক্তি নিজের ত্রুটি মেনে নিতে পারে, সে আত্মসচেতন, বিনয়ী এবং উন্নতির পথে এগিয়ে থাকা মানুষ। ভুল স্বীকার মানে আত্মশুদ্ধির সূচনা।
ভুল স্বীকার করা মানেই নিজের অহংকে নিয়ন্ত্রণ করা। একজন মানুষ যখন নিজের ভুলের দায় এড়ায় না, বরং তা অকপটে মেনে নেয়, তখন সে প্রকৃত অর্থে নৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি তওবারই এক রূপ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“প্রত্যেক মানুষই ভুল করে, আর সর্বোত্তম ভুলকারী সেই, যে তওবা করে।”
(তিরমিজি, হাদিস: ২৪৯৯)
অর্থাৎ, ভুল করা অপরাধ নয়, কিন্তু ভুল বুঝেও তাতে অটল থাকা অন্যায়। ভুল স্বীকার করার মধ্যেই রয়েছে আত্মসমালোচনার মহিমা, যা মানুষকে নতুনভাবে শুরু করার শক্তি দেয়।
একবার হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর মধ্যে তর্ক হয়। রাগের বশে আবু বকর (রা.) কিছু কথা বলে ফেলেন, পরে তিনি অনুতপ্ত হন এবং ওমর (রা.)-এর কাছে ক্ষমা চাইতে যান। কিন্তু ওমর (রা.) তখনো রাগে দরজা বন্ধ করে দেন। আবু বকর (রা.) তখন নবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে সব বলেন। নবী (সা.) শুনে বলেন,
“তোমাদের এই সঙ্গী আবু বকর কল্যাণে অগ্রগামী।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৬৪০)
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, নিজের ভুল স্বীকার করা কখনো অপমান নয়, বরং তা মর্যাদার চিহ্ন।
আরেকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় রাবিআহ (রা.) ও আবু বকর (রা.)-এর মধ্যে। সামান্য বিষয়ে রাগের পর আবু বকর (রা.) অনুতপ্ত হয়ে রাবিআহ (রা.)-কে বলেন, “তুমি আমাকেও একই কথা বলো, যাতে আমার অন্যায় মিটে যায়।” কিন্তু রাবিআহ (রা.) তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে নবী (সা.) বলেন,
“তুমি তাঁর সঙ্গে কটু কথা বলবে না; বরং বলো, ‘আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।’ এই ঘটনাগুলো আমাদের শেখায়—ভুল স্বীকার করা মানে বিনয় ও মানবিকতার পরিচয় দেওয়া।
নবীদের জীবনও এমন দৃষ্টান্তে ভরপুর। আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর অনুতপ্ত হয়ে বলেছিলেন,
“হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।”
(সুরা আরাফ, আয়াত: ২৩)
তাঁদের এই অনুতপ্ত প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন। বিপরীতে ইবলিস নিজের ভুল স্বীকার না করে অহংকার করে যুক্তি দেখিয়েছিল, ফলে সে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত হয়।
আরেক নবী ইউনুস (আ.) নিজের দায়িত্ব পালনে অস্থির হয়ে ভুল করেছিলেন। কিন্তু তিনি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন—
“হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; তুমি পবিত্র, আমি নিশ্চয়ই অন্যায় করেছি।”
(সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭)
ফলে আল্লাহ তাঁকে মুক্তি দেন। এটি প্রমাণ করে, ভুল স্বীকার মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে।
যে ব্যক্তি নিজের ভুল স্বীকার করে না, সে ক্রমে অহংকারী হয়ে ওঠে। নিজের দুর্বলতা না মেনে নেওয়ার ফলে সে বারবার একই ভুল করে। এতে আত্মবিকাশ থেমে যায়, সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়ে এবং আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। ইতিহাসে ফেরাউন, নামরুদ বা কারুনের মতো ব্যক্তির পতনের মূল কারণও ছিল এই অহংকার। ভুল বুঝেও তা না মানা।
ভুল স্বীকার করা কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও অপরিহার্য। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ভুল স্বীকার করলে মানসিক ভারমুক্তি আসে। অপরাধবোধ চেপে রাখলে উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ে। অন্যদিকে ভুল স্বীকার করলে সম্পর্ক মজবুত হয় এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
কোরআনে এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ ,
“যারা তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং তাদের কর্মে ভালো ও মন্দ মিশ্রিত করেছে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের তওবা কবুল করবেন।”
(সুরা তাওবা, আয়াত: ১০২)
অর্থাৎ, ভুল স্বীকারের মাধ্যমেই আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া লাভ করা যায়।
ভুল স্বীকার দুর্বলতার চিহ্ন নয়, বরং এটি নৈতিক সাহসের প্রতীক। যে ব্যক্তি নিজের ভুলের মুখোমুখি হতে পারে, সে-ই প্রকৃতভাবে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। ভুল স্বীকার মানে আত্মসমালোচনার সাহস থাকা—যা মানুষকে সত্যের পথে দৃঢ় করে তোলে।
সততা শুধু সত্য বলা নয়, নিজের ভুলের সামনে দাঁড়ানোর নামই প্রকৃত সততা। ভুল স্বীকারের এই শক্তিই মানুষকে আল্লাহর প্রিয় বানায় এবং নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ করে তোলে।
লেখক: রাশিদুল ইসলাম রাশেদ,(বগুড়া)