বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নাম ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ বা এনসিপি। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের রাজনৈতিক ভার্সন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এনসিপি। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সেই বিপুল জনসমর্থন এখন আর নেই বললেই চলে। পানির প্রবাহ কমে গেলে যেমন নদীর পাড়ে বালু জমে, তেমনি এনসিপির মাঠের জনপ্রিয়তাও সময়ের সাথে সাথে নিভে যাচ্ছে।
দলীয় নিবন্ধনের স্বীকৃতি পাওয়ার পরও এনসিপি এখনো নিজেদের রাজনৈতিক প্রতীক বরাদ্দ পায়নি। দলটির দাবি ছিল ‘শাপলা’ প্রতীক, কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা দিতে রাজি হয়নি। কমিশন জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিকল্প প্রতীক বাছাই না করলে তারা নিজেরাই প্রতীক নির্ধারণ করে দেবে। এই প্রতীক সংকটের কারণে এনসিপির ভেতরে এখন হতাশা এবং বিভ্রান্তি— কারণ প্রতীক ছাড়া ভোটারদের কাছে পৌঁছানো কঠিন।
একইসঙ্গে দলটি এখন জোট রাজনীতির হিসাব কষছে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে তারা। যদিও বাস্তবতা বলছে, এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলা যায়। তাই তারা বিজয়ী দলের সঙ্গে জোটে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এনসিপির একাধিক নেতার মতে, বিএনপি যদি জয়ের কাছাকাছি যায়, তবে তারা বিএনপির সঙ্গেই জোটে থাকবে। এজন্য বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা চলছে। তারা জোটগতভাবে আসন বণ্টনেরও দাবি তুলেছে। তবে প্রকাশ্যে তারা এসব জোট গঠনের বিষয় অস্বীকারও করেছে বহুবার।
দলের এই কৌশল নিয়েও দলের ভেতরে মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি-জামায়াতের ছায়ায় থাকা মানে ‘পুরনো রাজনীতির’ ভেতরেই হারিয়ে যাওয়া। অন্যদিকে, জোট ছাড়া স্বাধীনভাবে নির্বাচনে গেলে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং প্রতীক সংকট বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
জুলাই বিপ্লবের সময় তরুণদের মধ্যে প্রবল আলোচনার জন্ম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন । বৈষম্যবিরোধী স্লোগান দিয়ে তারা নতুন রাজনীতির প্রতীক হয়ে ওঠে। কিন্তু আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে রূপান্তরের পথে তাদের পদক্ষেপ দুর্বল ও অগোছালো। ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে কিছুটা উপস্থিত থাকলেও গ্রামীণ ভোটারদের কাছে এনসিপি এখনো অপরিচিত নাম।
এনসিপিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও সংশয়ও আছে। অনেকেই মনে করছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মতো দক্ষ নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতা এখনো এই দলের মধ্যে তৈরি হয়নি।
তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই— শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনে এই তরুণরাই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। তাদের সাহসী ভূমিকার কারণেই সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ জুলাই বিপ্লবে অংশ নেয়। যা দীর্ঘদিনের নিরব ও ক্লান্ত রাজনীতিতে এক নতুন হাওয়া এনে দেয়। কিন্তু এখন সেই সাহস ও উচ্ছ্বাসকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপ দেওয়া তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
রাজনীতির ময়দানে প্রতীক ও সংগঠন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন জনআস্থা। এনসিপি যদি জনগণের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে, যদি নেতৃত্বের মধ্যে স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ না আনে, তবে তাদের সামনে ভবিষ্যৎ পথ কঠিন হয়ে উঠবে। বিপরীতে, যদি তারা মাঠ পর্যায়ে পুনরায় সংগঠন গড়ে, জোট কৌশলকে সুসংগঠিত করে এবং প্রতীকের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন রাজনীতির সূচনা করার সম্ভাবনা রাখে।
প্রশ্ন এখন একটাই— এনসিপি কি আদর্শ ধরে রেখে রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকতে পারবে, নাকি জনপ্রিয়তার ঢেউ শেষে, তারা আবার হারিয়ে যাবে প্রচলিত রাজনীতির কোলাহলে? সময়ই দেবে সেই উত্তর।