মোহাম্মদ বিন সালমান: সৌদি রাজতন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রে

মোহাম্মদ বিন সালমান ১৯৮৫ সালের ৩১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিদেশে পড়াশোনা করেননি এবং কখনও সৌদি সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হননি। তিনি রিয়াদের রয়্যাল অ্যান্ড সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করেন।ছোটবেলায় দুষ্টু ছিলেন, এবং ইংরেজি শিক্ষার তুলনায় প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার বেশি আগ্রহ ছিল। ২০০৭ সালে তিনি সারা বিনতে মাশুরকে বিয়ে করেন এবং তাদের চার সন্তান রয়েছে।
ডেস্ক রিপোর্ট:
২০১৫ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর রাজপরিবারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। নতুন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ প্রথমে পুত্র মুকরিনকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন মুকরিনের বয়স ছিল ৬৮ বছর।
কিন্তু মাত্র তিন মাসের মধ্যে সালমান বিন আবদুল আজিজ তার পুত্রকে বরখাস্ত করে। তার পরিবর্তে ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্স বানানো হয়। একই সঙ্গে ২৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমানকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হয়। এভাবে সৌদি রাজনীতিতে তার দ্রুত উত্থান শুরু হয়।
মোহাম্মদ বিন সালমান ১৯৮৫ সালের ৩১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিদেশে পড়াশোনা করেননি এবং কখনও সৌদি সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হননি। তিনি রিয়াদের রয়্যাল অ্যান্ড সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করেন।
ছোটবেলায় দুষ্টু ছিলেন, এবং ইংরেজি শিক্ষার তুলনায় প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার বেশি আগ্রহ ছিল। ২০০৭ সালে তিনি সারা বিনতে মাশুরকে বিয়ে করেন এবং তাদের চার সন্তান রয়েছে।
প্রথম দিকে মোহাম্মদ বিন সালমান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খুব কম জানত। মোহাম্মদ বিন নায়েফ তখনও মার্কিন প্রশাসনের প্রশংসিত নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি এফবিআই-এর কোর্স ও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সন্ত্রাস দমন কৌশলের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে ২০০৯ সালের আগস্টে আল-কায়েদা দ্বারা তার ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলার চেষ্টা হয়। সেই সময় মোহাম্মদ বিন সালমানকে কেউ চেনে না।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দ্রুত প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। ডেভিড বি. ওটাওয়ের মতে, তিনি তার পদ ব্যবহার করে বাদশাহকে পরিবারের এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের থেকে আলাদা করেন। এমনকি বাদশাহকে তার স্ত্রী, অর্থাৎ মোহাম্মদ বিন সালমানের মা-এর সঙ্গেও দেখা করতে বাধা দেওয়া হয়। তার মা এবং দুই বোনকে গৃহবন্দি রাখা হয়, এবং বাদশাহকে এ বিষয়ে জানানো হয় না।
২০১৫ সালের মার্চে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি বিমান বাহিনী হামলা চালায় মোহাম্মদ বিন সালমানের তত্ত্বাবধানে। প্রাথমিকভাবে সৌদি জনগণ এই হামলার প্রশংসা করে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটিকে মোহাম্মদ বিন সালমানের পররাষ্ট্রনীতির গাফিলতি হিসেবে দেখা হতে থাকে।
এক পর্যায়ে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্স পদ থেকে সরিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২০১৫ সালের ২০ জুন রাতে মক্কায় রাজপরিবারের সদস্যরা একত্রিত হন। বৈঠকের আগে নায়েফকে হেলিকপ্টারে তাড়াহুড়ো করে বাদশাহর সঙ্গে দেখা করতে পাঠানো হয়।
বৈঠক শুরু হওয়ার আগেই নায়েফের দুই বডিগার্ডের অস্ত্র ও মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে। অবশেষে পরের সকালে তিনি পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন। তাকে পাশের কক্ষে নিয়ে গিয়ে বাদশাহর উপস্থিতিতে ভিডিও রেকর্ড করা হয়, যা পরে সম্প্রচার করা হয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে রয়্যাল কোর্টের মুখপাত্র দাবি করেছেন, জাতীয় স্বার্থে নায়েফকে সরানো হয়েছিল। তবে অনামিক সৌদি কর্মকর্তারা পরে জানান, নায়েফকে সরানোর পেছনে ছিল মরফিন ও কোকেনে আসক্তি। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টও বাজেয়াপ্ত করা হয়। মোহাম্মদ বিন নায়েফ প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেই সময় এমবিএস পিয়ানোতে ধ্রুপদী সুর বাজিয়ে সবাইকে অবাক করেন।
মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হওয়ার আগেই বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ার চেষ্টা শুরু করেন। একবার এক বিচারকের কাছে ৪৪০ ফুট লম্বা ইয়ট কিনতে ৫০ কোটি ডলার খরচ করা ও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিত্রকর্ম কেনার ঘটনায় আলোচিত হন।
২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়া হয় এবং আবায়া পরিধান শিথিল করা হয়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি মূলত অর্থনৈতিক কারণে নেওয়া পদক্ষেপ। নারী ও তরুণদের মন জয় করা মোহাম্মদ বিন সালমানের লক্ষ্য ছিল।
ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পরই মোহাম্মদ বিন সালমান সরকারে বিরোধিতা কমানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেন। সৌদি আরবে অন্তত ১০ হাজার প্রিন্সের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় প্রায় ১০০ জনকে সরকারে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হয়।২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর প্রিন্স ও ব্যবসায়ীসহ ৩৮০ জনকে গ্রেফতার করে জরিমানা আদায় করা হয়। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরির পদত্যাগও তার প্রভাবের অংশ হিসেবে ধরা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, সৌদি সরকার ২,৩০৫ জনকে আটকে রেখেছে, যার মধ্যে ২৫১ জন তিন বছরের বেশি সময় বিচার ছাড়াই বন্দি রয়েছেন। সাংবাদিক জামাল খাসোগজি হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বিতর্কিত। CIA ও অন্যান্য অনুসন্ধান অনুযায়ী, হত্যার নির্দেশ মোহাম্মদ বিন সালমান দিয়েছিলেন। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছিলেন, তবে নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
সৌদি রাজপরিবারে ঐতিহ্যগত পরামর্শ পরিষদ ‘শুরা’-র মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রথা ভেঙে এমবিএস একক শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি নিজস্ব নীতিমালা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা সমালোচনা বরদাস্ত করেন না।
মোহাম্মদ বিন সালমান বিলাসবহুল জীবনযাপন ও দামী সম্পদে বিনিয়োগের জন্য পরিচিত। ইয়ট ও শিল্পকর্ম ক্রয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা রয়েছে। তবে এ সবকিছুর মধ্যেও তিনি সৌদি রাজতন্ত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী যুবরাজ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বর্তমানে ৩৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন। তিনি দেশের অর্থনীতি, সামাজিক সংস্কার ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার নেতৃত্বে সৌদি আরবকে আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে তার শাসন পদ্ধতি ও মানবাধিকার নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার ঝড়ও চলমান।
শক্তি, রাজনৈতিক কৌশল এবং কঠোর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি সৌদি রাজপরিবারে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার নেতৃত্বে সৌদি আরব আধুনিকীকরণের পথে এগোচ্ছে, তবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনার ছায়া সবসময় থাকবে।