নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন আওয়ামী লীগের ভোটাররা?

সেলিম সরকার:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নজিরবিহীন মোড় — আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভবত অংশ নিতে পারছে না বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সংবিধানিক ও রাজনৈতিক নানা জটিলতায় দলটি নির্বাচন কমিশনের বৈধ প্রার্থী তালিকা থেকে ইতোমধ্যেই বাদ পড়েছে। দেশের রাজনীতিতে এর প্রভাব শুধু দল নয়, তার লক্ষ কোটি সমর্থক ও ভোটারের ওপর পড়েছে সবচেয়ে বেশি।
দলটি এখন এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটে ভুগছে। তাদের অগণিত ভোটার আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে যাবেন, না কি যাবেন না? ভোট দেবেন, নাকি প্রতিহত করার ডাক দেবেন তা নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছেনন না নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। নির্বাচন নিয়ে আস্তে আস্তে তাদের মাঝে বেড়ে উঠছে হতাশা, ক্ষোভ ও দ্বিধা।
সাম্প্রতিক অনলাইন জরিপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ধরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে মতামত সংগ্রহে দেখা গেছে— আওয়ামী লীগের একাংশের ভোটার নির্বাচনকে ‘একতরফা ও পূর্বনির্ধারিত’ মনে করছেন। এমনকি কেউ কেউ একে ‘প্রহসনের নির্বাচন’ বলতেও পিছপা নন।
নেতাদের অনেকেই বলছেন, “যে নির্বাচনে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল থাকবে না, সেখানে অংশ নেওয়া মানে ওই প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়া।”
অন্যদিকে, বিরুদ্ধমতও আছে— কেউ কেউ বলছেন, “আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, কিন্তু গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও জরুরি। তাই ভোট কেন্দ্রে যাওয়া উচিত।”
এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গিই স্পষ্ট করছে— আওয়ামী লীগ সমর্থকরা আজ দ্বিধান্বিত, বিভক্ত ও রাজনৈতিকভাবে হতাশ। কেউ প্রস্তুত ‘নির্বাচন প্রতিহত’ করার আন্দোলনে, কেউ তেমন আহ্বান চান দলের কেন্দ্র থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে আলোচনা থেকে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের বিশেষত তরুণ সমর্থকদের একাংশ সরাসরি নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিতে চায়। তারা চাইছে কেন্দ্র থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হোক- নির্বাচন বর্জন? নাকি ভোটাধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ?
যদিও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি ভোটারদের জন্য কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়নি, অনেক স্থানীয় নেতাকর্মী তাঁদের অনুসারীদের বলছেন, “আমরা যদি মাঠে না নামি, তাহলে এই নির্বাচন ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ করে দেবে।”
সেই অনুযায়ী অনেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন নির্বাচনের দিন বিক্ষোভ, কেন্দ্র ঘেরাও ও সাংগঠনিক প্রতিরোধ কর্মসূচির জন্য। অপরদিকে বিকল্প প্রার্থীর পক্ষে নীরব অংশগ্রহণের পক্ষে একাংশ। তাদের মতে, ‘ভোট না দিলে শূন্যতা পূরণ হবে অন্যভাবে। আবার অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগ না থাকলেও ভোটে অংশ না নিলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে দল আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
তাদের মতে, “আমরা নির্দলীয় ভালো প্রার্থীকে বেছে নিয়ে হলেও ভোটে অংশ নিতে পারি। সেটা এজন্য যে, বিএনপি বা জামায়াতের যেন একতরফা জয় না হয়।” এই অংশটি দলানুগত হলেও গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে।
কেন্দ্রের নীরবতা কী বার্তা দিচ্ছে?
যেখানে অন্যান্য দল নির্বাচনের হাওয়ায় চষে ফেলছে মাঠ, সেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও অপেক্ষাকৃত সংযত। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামীলীগ হয়তো আন্তর্জাতিক সমর্থনের দিকে তাকিয়ে আছে; নয়তো একটি কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে— পরিস্থিতি বুঝে হয় প্রতিহত করবে, নয়তো অন্তর্ভুক্ত হবে স্বতন্ত্র বা বিকল্প প্রার্থীর পক্ষে। এই অনিশ্চয়তাই ভোটারদের দ্বিধা বাড়িয়ে দিচ্ছে, এবং অনেকের মনে তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত রাজনৈতিক শূন্যতা।
জরিপের তথ্য বলছে, আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত প্রায় ৪৫% ভোটার মনে করেন “দল না থাকলে ভোটে অংশ নেব কি না, তা নিশ্চিত নই।” প্রায় ৩০% বলছেন, “ভোট কেন্দ্রে যাব না।” আর ২৫% বলছেন, “ভোট দেব, তবে কাকে দেব এখনো স্থির করিনি।”