বগুড়ায় প্রযুক্তির ফাঁদে ২৭ লাখ টাকার প্রতারণা: ডিবির জালে মূলহোতা

সেলিম সরকার, ওয়াহেদ ফকির, বগুড়া:
একটি ফোন কল। অপর প্রান্তে ভদ্র কণ্ঠে ভেসে এলো—“আপনার নাতি মেধাবৃত্তি পেয়েছে, টাকা পেতে ব্যাংক হিসাব নম্বরটা দিন।” এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রতারণার গল্প। শেষ পর্যন্ত সেই ফোন কলের সূত্র ধরে উধাও হয়ে যায় প্রায় ২৭ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৫ টাকা।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়—ঘটনার ৭৬ দিন পর, প্রযুক্তির সহায়তায় বগুড়ার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পৌঁছে যায় ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার জঙ্গলপাক্ষা গ্রামের এক তরুণের ঘরে। সেখান থেকেই হাতেনাতে ধরা পড়ে এই প্রতারণা চক্রের মূল হোতা রাজু মুন্সি (২৩)। আটক রাজু ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার জঙ্গল পাক্ষা গ্রামে।
প্রতারণার কৌশল: সরকারি পরিচয়ে ফাঁদ
ঘটনার শুরু ২৭ জুলাই ২০২৫, বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে। বগুড়া শহরের বড়গোলা এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের মেয়ের জামাই মো. আব্দুল হকের ফোনে আসে অজানা নম্বর থেকে একটি কল। অপরপ্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানান—রফিকুল ইসলামের নাতি মেজবাউল হক ‘মেধাবৃত্তির’ জন্য নির্বাচিত হয়েছে, টাকা পেতে ব্যাংক হিসাব দরকার।
সরল বিশ্বাসে আব্দুল হক তার শ্বশুরের ব্যাংক হিসাব নম্বর ও ফোন নম্বর দিয়ে দেন। এরপর প্রতারকরা সেই মোবাইলে একটি পিন নম্বর পাঠায়—আর সেটাই হয়ে ওঠে সর্বনাশের সূত্র। পিনটি শেয়ার করার সঙ্গে সঙ্গে রফিকুল ইসলামের প্রাইম ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রিত সেবা ইনটেক মার্চেন্ট একাউন্টে টাকার স্রোত বয়ে যায়—একটার পর একটা লেনদেন, সবমিলিয়ে প্রায় সাতাশ লাখ টাকা তুলে নেয় প্রতারকচক্র।
প্রযুক্তির সহায়তায় ডিবির অভিযান:
অভিযোগ পাওয়ার পর বগুড়া সদর থানায় মামলা নং–৪৩ (তারিখ ১১/১০/২০২৫) দায়ের হয় দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারায়। এরপর মাঠে নামে ডিবি বগুড়ার একটি বিশেষ টিম। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, মোবাইল ট্র্যাকিং ও গোয়েন্দা অনুসন্ধানের মাধ্যমে টিমটি প্রতারক চক্রের অবস্থান শনাক্ত করে। ১১ অক্টোবর সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে, ডিবির সদস্যরা গোপন অভিযানে যায় ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার জঙ্গলপাক্ষা এলাকায়। অভিযান শেষে গ্রেফতার হয় রাজু মুন্সি (২৩)।
তার কাছ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও প্রতারণায় ব্যবহৃত একটি সিম কার্ড উদ্ধার করে পুলিশ। ডিবির ভাষ্যে: “এটা সংগঠিত সাইবার প্রতারণা চক্র।”
ডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “রাজু একা নয়, তার সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রযুক্তি-দক্ষ সদস্য কাজ করে। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দপ্তরের পরিচয় দিয়ে ফোন করে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। এরপর ‘সেবা ইনটেক’ বা অনলাইন মার্চেন্ট প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে টাকা সরিয়ে নেয়।”
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজু স্বীকার করেছে, এই চক্র বহুদিন ধরে একই কৌশলে প্রতারণা চালিয়ে আসছে। তারা মূলত বৃদ্ধ বা প্রযুক্তি অজানা মানুষদের টার্গেট করত।
প্রতারনার ধরন বদলাচ্ছে, সচেতনতা জরুরি
পুলিশ বলছে, এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট, সাইবার প্রতারণা এখন শুধুই অনলাইন নয়—এটি ফোনও এখন ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের গভীরে ঢুকে পড়েছে। ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারকরা সাধারণত সরকারি প্রকল্প, ভাতা, বৃত্তি বা অনুদানের নামে ফাঁদ পাতে।
তাদের মতে, “এখনই যদি সাধারণ মানুষকে আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন না করা যায়, তাহলে এই ধরনের প্রতারণা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। তদন্ত এখনো চলছে। তবে একটি সত্য এখনই স্পষ্ট— একটি ফোন কলই পারে ২৭ লাখ টাকা উধাও করতে, যদি আমরা সচেতন না হই ।”
প্রতারক রাজু মুন্সির গ্রেফতারে আপাতত এক মামলার রহস্য উন্মোচন হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের ধারণা, তার পেছনে আরও বড় চক্র কাজ করছে। – বাংলার ২৪ ঘণ্টা